রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর চরিত্র মাধুরী

চরিত্র মাধুরী

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর চরিত্র মাধুরী

গ্রন্থনায়: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানি
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব

বইটি ডাউনলোড করুন (PDF)

বইটি ডাউনলোড করুন (Word)
সূচীপত্র:

 ভূমিকা 
 সুন্দর চরিত্র: মর্যাদা, সংজ্ঞা, মৌলিক উপাদান এবং চরিত্রবান হওয়ার উপায় 
 উত্তম চরিত্রের মর্যাদা সংক্রান্ত কতিপয় হাদিস 
 পূর্বসূরিদের থেকে উত্তম চরিত্রের ব্যাখ্যা 
 আমরা কিভাবে উত্তম চরিত্রের গুণে গুণান্বিত হবো? 
 প্রেরণা-১: অনুপম চরিত্রের এক আদর্শ পুরুষ 
 প্রেরণা-২: উন্নত চরিত্র গঠনের মর্যাদা 
 প্রেরণা-৩: উন্নত চরিত্রের জন্য হৃদয় নিংড়ানো একগুচ্ছ দুআ 
 প্রেরণা-৪: ক্ষমা এক মহৎ গুণের নাম 
 প্রেরণা-৫: বিনয়ের অপূর্ব দৃষ্টান্ত 
 প্রেরণা-৬: বিনয়ী ও অহংকার মুক্ত জীবনের নির্দেশিকা 
 প্রেরণা-৭: অহংকারীদের পরিণতি 
 প্রেরণা-৮: ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা 
 প্রেরণা-৯: রাগ নিয়ন্ত্রণ 
 প্রেরণা-১০: ধৈর্য ধারণ 
 প্রেরণা-১১: দয়া ও নম্রতা 
 প্রেরণা-১২: দয়া ও নম্রতা বিষয়ে একগুচ্ছ মনি-মুক্তা 
 প্রেরণা-১৩: এক সাহসী মানুষের গল্প 
 প্রেরণা-১৪: দয়া ও করুণার মূর্ত প্রতীক 
 প্রেরণা-১৬ : ন্যায়-ইনসাফের সার্বজনীন ষোষণা 
 প্রেরণা-১৭: রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর লজ্জাশীলতা 
 প্রেরণা-১৮: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ভদ্রতা ও শিষ্টাচার 
 প্রেরণা-১৯: রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দানশীলতা 
 প্রেরণা-২০: রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কৌতুক 
 প্রেরণা-২১: রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ঘুম 
 প্রেরণা-২২: রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কথা বলার ধরণ 
 প্রেরণা-২৩: দুনিয়ার অর্থ-সম্পদের প্রতি অনাগ্রহ 
 প্রেরণা-২৪: রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সাহাবিদের ক্ষুধা-দরিদ্রতা 
 প্রেরণা-২৫: রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ক্রন্দন 
 প্রেরণা-২৬: রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর স্বপ্ন 
 প্রেরণা-২৭: শিশুদের প্রতি প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাাইহি ওয়া সাল্লাম-এর স্নেহ, মমতা ও একগুচ্ছ স্নিগ্ধ ভালবাসা 
 প্রেরণা-২৮: দাম্পত্য জীবন ও স্ত্রীদের সাথে আচরণ 
 ইসলাম নির্দেশিত যে সব চারিত্রিক অধ:পতনের কারণে সমাজিক মূল্যবোধ ধ্বংসের পথে 
 একজন আদর্শ মুসলিমের ব্যক্তিত্ব, চরিত্র ও গুণাবলী 
 ইহুদিদের স্বভাব-চরিত্র (২০টি) 


ভূমিকা:
প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক সত্যিকার প্রেরণার উজ্জ্বল বাতিঘর। অনুপম চরিত্রের এক আদর্শ মহা পুরুষ তিনি। স্বয়ং মহান আল্লাহ সাত আসমান থেকে তার চারিত্রিক সনদ দান করে বলেন,
وَإِنَّكَ لَعَلَىٰ خُلُقٍ عَظِيمٍ

“(হে নবী) আপনি অবশ্যই মহান চরিত্রের অধিকারী।” [সূরা ক্বালাম: ৪]

সুন্দর আচরণ, ক্ষমা, উদারতা, নিময়-নম্রতা, অহংকার মুক্ত ও সহজ-সরল জীবন, ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা, রাগ নিয়ন্ত্রণ, দয়া ও ক্ষমা প্রদর্শন, সাহসিকতা, ন্যায়-ইনসাফ, লজ্জাশীলতা, দানশীলতা, হাসি-কৌতুক ইত্যাদি মানবিক গুণাবলীর ক্ষেত্রে এক অনন্য-অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন তিনি। তাঁর কথা বলার ধরণ, খাওয়া-দাওয়া, ঘুম, দুনিয়ার সম্পদের প্রতি অনাগ্রহ, শিশুদের সাথে আচরণ, দাম্পত্য জীবন ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রেই তিনি বিশ্ব মানবতার সামনে এক বিশাল প্রেরণার উৎস ও অনুকরণীয় মহান আদর্শ। আল্লাহ তাআলা তার রাসূল সম্পর্কে বলেন,


لَّقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِّمَن كَانَ يَرْجُو اللَّهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللَّهَ كَثِيرًا

“যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্যে রসূলুল্লাহর মধ্যে উত্তম নমুনা রয়েছে।” [সূরা আহযাব: ২১]

আমরা যেন প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালামকে আমাদের বাস্তব জীবনে অনুসরণ-অনুকরণ করতে পারি এবং সমাজে তার চারিত্রিক সৌন্দর্যের সুবাতাস ছড়িয়ে পড়ে সে উদ্দেশ্যে আমরা এখানে প্রিয় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর এ সকল অনুপ্রেরণা দায়ক ও অনুসরণীয় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো কম কথায় সহজ-সরলভাবে কুরআন-হাদিসের দলিলের আলোকে উপস্থাপন করার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তাওফিক দান করুন। আমিন।


সুন্দর চরিত্র: মর্যাদা, সংজ্ঞা, মৌলিক উপাদান এবং চরিত্রবান হওয়ার উপায়

প্রশ্ন: ইসলামের দৃষ্টিতে সুন্দর চরিত্রের মর্যাদা কি এবং সুন্দর চরিত্র বলতে কী বুঝায়? চরিত্র সুন্দর করার জন্য কী কী বিষয় থাকা জরুরি এবং আমরা কিভাবে সুন্দর চরিত্রে চরিত্রবান হতে পারব?

উত্তর:

নিম্নে হাদিস থেকে সুন্দর চরিত্রের মর্যাদা, পূর্বসূরিদের থেকে এর সংজ্ঞা ও চরিত্রের কতিপয় মৌলিক উপাদান এবং কিভাবে সুন্দর চরিত্রের অধিকারী হতে পারব তার উপায় সম্পর্কে আলোচনা তুলে ধরা হল:

◈◈ উত্তম চরিত্রের মর্যাদা সংক্রান্ত কতিপয় হাদিস:

➧ ১. ঈমানের পূর্ণতা উত্তম চরিত্রের মাধ্যমে ঘটে থাকে:

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

أكملُ المؤمنين إيمانًا أحسنُهم خُلقًا

“মুমিনদের মাঝে পূর্ণ ইমানদার সেই ব্যক্তি যে তাদের মধ্যে সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী।” [তিরমিযি, অধ্যায়: কিতাবুর রিযা, অনুচ্ছেদ: স্বামীর উপর স্ত্রীর অধিকার, সিলসিলা সাহীহা, হা/২৮৪।]

➧ ২. উত্তম চরিত্রের কারণে বান্দা প্রভুর জন্য বিনয় অবনতভাবে ইবাদত কারীদের মর্যাদা লাভ করে থাকে:

রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষণা করেন,

إِنَّ الُمؤْمِنَ لَيُدْركُ بِحُسنِ خُلُقِه درَجةَ الصائمِ القَائمِ

“নিঃসন্দেহে মুমিন ব্যক্তি তার সর্বোত্তম চরিত্রের মাধ্যমে সিয়াম পালনকারী, রাত জেগে ইবাদত কারীর মর্যাদায় ভূষিত হয়।” [আবু দাউদ, অধ্যায়: কিতাবুল আদাব, অনুচ্ছেদ: উত্তম চরিত্র, সহিহ আল জামে, হা/ ১- ১৯৩২]

➧ ৩. উত্তম চরিত্র কিয়ামত দিবসে বান্দার আমলের পাল্লাকে ভারী করে দিবে:

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

مَا مِنْ شَيءٍ أَثْقَلُ في ميزَانِ المُؤمِنِ يَومَ القِيامة مِنْ حُسْنِ الخُلُقِ

“কিয়ামত দিবসে উত্তম চরিত্রের চাইতে ভারী কোন কিছু পাল্লায় রাখা হবে না।” [তিরমিযি, অধ্যায়: কিতাবুল বির ওয়াস সিলাহ, অনুচ্ছেদ: উত্তম চরিত্র, সহীহুল জামে]

➧ ৪. যে বিষয়টি অধিক হারে মানুষকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে তা হল, এই উত্তম চরিত্র:

سُئِلَ رسولُ اللَّه ﷺ عَنْ أَكثرِ مَا يُدْخِلُ النَّاسَ الجَنَّةَ، قَالَ: تَقْوى اللَّهِ وَحُسْنُ الخُلُق

“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে প্রশ্ন করা হল, সর্বাধিক কোন বিষয়টি মানুষকে জান্নাতে নিয়ে যাবে? তিনি বললেন, “আল্লাহ ভীতি এবং উত্তম চরিত্র।” [তিরমিযি, অধ্যায়: কিতাবুল আদাব, অনুচ্ছেদ: উত্তম চরিত্র, ইবনে মাজাহ, অধ্যায়: কিতাবুয যুহুদ, অনুচ্ছেদ: পাপ কাজের আলোচনা ও সিলসিলা সাহীহা, হা/৯২৭]

◈◈ পূর্বসূরিদের থেকে উত্তম চরিত্রের ব্যাখ্যা:

এ প্রসঙ্গে হাফেজ ইবনে রজব পূর্বসূরি বিদ্বানদের অনেক উক্তি উল্লেখ করেছেন। নিম্নে কয়েকটি পেশ করা হল:

◍ ক) হাসান বাসরি রহ. বলেন, “উত্তম চরিত্র হল, আতিথেয়তা, দানশীলতা এবং ধৈর্যাবলম্বন।”

◍ খ) ইবনুল মুবারক রহ. বলেন, “উত্তম চরিত্র হল, মানুষের সামনে প্রফুল্ল বদনে থাকা, সৎ উপদেশ দেওয়া এবং কাউকে কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকা।”

◍ গ) ইমাম আহমদ রহ. বলেন, “উত্তম চরিত্র হচ্ছে, তুমি অযথা ক্রুদ্ধ হবেনা এবং করো প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ রাখবে না।”

◍ ঘ) অপর কোন বিদ্বান বলেছেন, “উত্তম চরিত্র বা সদাচার হল, আল্লাহর জন্য ক্রোধ সংবরণ করা। পাপী এবং বিদআতি ব্যতীত সকল ধরণের মানুষের সামনে হাস্যোজ্জ্বল ভাব প্রকাশ করা, ভুলত্রুটিতে লিপ্ত ব্যক্তিদেরকে শিক্ষা দেওয়া বা তাদের উপর দণ্ডবিধি কায়েমের উদ্দেশ্য ব্যতীত তাদেরকে ক্ষমা করে দেওয়া। প্রত্যেক মুসলমান এবং চুক্তিতে আবদ্ধ অমুসলমানদেরকে কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকা। তবে অন্যায়ের প্রতিরোধ এবং সীমালঙ্ঘন ব্যতীত মাজলুমের অধিকার আদায়ের উদ্দেশ্যে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে।” [জামিউল উলূম ওয়াল হিকাম, পৃষ্ঠা নং ১৮২]

মূলত: উপরোল্লিখিত প্রত্যেকটি মন্তব্যই ‘উত্তম চরিত্র’ বা সদাচারের অন্তর্গত।

◈◈ আমরা কিভাবে উত্তম চরিত্রের গুণে গুণান্বিত হবো?

➧ ১. আমরা তখনই সদাচার ও উত্তম চরিত্রে সৌন্দর্যে বিকশিত হতে পারব যখন আমরা সকল নবী-রসূলের সরদার, বিশ্বনবী মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পদাঙ্ক অনুসরণ করবো। কেননা তিনিই এই বিষয়টিকে যথাযথভাবে বাস্তবায়িত করেছেন। মহান আল্লাহ তাঁর সম্পর্কে বলেন,

وَإِنَّكَ لَعَلى خُلُقٍ عَظِيمٍ

“আর অবশ্যই আপনি সুমহান চরিত্রের অধিকারী।” [সূরা কলম: ৪] সুতরাং এ ক্ষেত্রে তিনিই হলেন সর্বোত্তম আদর্শ ও অনুকরণীয়। আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,

لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَة

“নিশ্চয় তোমাদের জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জীবনীতে রয়েছে সর্বোত্তম নমুনা বা আদর্শ।” [সূরা আহযাব: ২১]

অতএব, মুসলিম ব্যক্তির উপর আবশ্যক হল, সে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জীবনের প্রতিটি দিক সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করবে এবং সে সম্পর্কে গবেষণা করবে, তাঁর প্রতিপালকের সাথে তাঁর কিরূপ সম্পর্ক ছিল? কেমন ছিল আচরণ মানুষের সাথে? কিরূপ ব্যবহার করতেন পরিবারের সদস্যদের সাথে? তাঁর সাথী সাহাবিদের সাথে কিভাবে চলাফেরা করতেন? অমুসলিম সম্প্রদায়ের সাথে কিরূপ আচরণ করতেন?

➧ ২. এ ছাড়া সদ্যগুণ অর্জনের আরও পন্থা হল, পরিচ্ছন্ন অন্তরের অধিকারী পরহেজগার ও চরিত্রবান ব্যক্তিদের সংস্পর্শ লাভের চেষ্টা করা, তাদের বৈঠকে বসা। কেননা একজন মানুষ অন্য জনের সংস্পর্শে আসলে তার প্রভাবে প্রভাবিত হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

 الرَّجُلُ عَلَى دِينِ خَلِيلِهِ فَلْيَنْظُرْ أَحَدُكُمْ مَنْ يُخَالِلُ

“ব্যক্তি তার বন্ধুর ধর্ম বা রীতি -নীতির অনুসারী হয়। সুতরাং তোমরা দেখে নাও কার সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করবে।”

[আবু দাউদ, অধ্যায়: কিতাবুল আদাব, অনুচ্ছেদ: যার সাথে বৈঠকে বসার আদেশ দেওয়া হবে। তিরমিযি, অধ্যায়: কিতাবুয যুহুদ, অনুচ্ছেদ: ন্যায় ভাবে সম্পদ অর্জন। সহীহুল জামে, হা/৩৫৪৫]

অতএব প্রতিটি মুসলিমের উপর অপরিহার্য হচ্ছে, সচ্চরিত্র বান লোকদের সাথে বন্ধুত্ব করা এবং অসৎ ও খারাপ চরিত্র সম্পন্ন ব্যক্তিদের সঙ্গ ত্যাগ করা।

➧ ৩. কুরআন এবং হাদিস থেকে সুন্দর চরিত্র এবং আচরণ শেখা।

➧ ৪. সুন্দর চরিত্র এর জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করা।

➧ ৫. নিজের মধ্যে যে সকল খারাপ বৈশিষ্ট্য ও বাজে আচরণ আছে সেগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো দূর করা।

➧ ৬. আপনি মানুষের নিকট থেকে যে ধরণের আচরণ পছন্দ করেন তাদের সাথে ঠিক সেইরকম আচরণ করা ইত্যাদি।

প্রেরণা-১: অনুপম চরিত্রের এক আদর্শ পুরুষ

প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন অনুপম সুন্দর চরিত্রের অধিকারী ছিলেন এক মহান ব্যক্তিত্বের অধিকারী। নিম্নে এ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা পেশ করা হল:

১) আসমান থেকে চারিত্রিক সনদ:

মহান আল্লাহ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ব্যাপার সাত আসমান থেকে চারিত্রিক সনদপত্র নাজিল করেছেন। তিনি বলেছেন,

وَإِنَّكَ لَعَلَى خُلُقٍ عَظِيمٍ

“আর অবশ্যই আপনি মহৎ চরিত্রের অধিকারী।” [সূরা কলম: ৪]

তিনি আরও বলেছেন,

لَّقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّـهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِّمَن كَانَ يَرْجُو اللَّـهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللَّـهَ كَثِيرًا

“নিশ্চিতভাবে আল্লাহর রাসূলের মধ্যে উত্তম নমুনা (অনুসরণীয় আদর্শ) রয়েছে ঐ ব্যক্তির জন্য যে আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে।” [সূরা আহযাব: ২১]

◈ ২) সবচেয়ে সুন্দর চরিত্রের অধিকারী:

প্রখ্যাত সাহাবি বারা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم أَحْسَنَ النَّاسِ وَجْهًا وَأَحْسَنَهُ خَلْقًا، لَيْسَ بِالطَّوِيلِ الْبَائِنِ وَلاَ بِالْقَصِيرِ

“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মুখমণ্ডল ছিল সবচেয়ে সুন্দর এবং চরিত্রও ছিল সবচেয়ে আকর্ষণীয়। তিনি অতিরিক্ত লম্বাও ছিলেন না এবং বেমানান বেঁটেও ছিলেন না।” [সহিহ বুখারি (ইসলামিক ফাউন্ডেশন) অধ্যায়: ৫০/ আম্বিয়া কিরাম, পরিচ্ছেদ: ২০৭৩. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে বর্ণনা]

◈ ৩) কুরআনের বাস্তব উদাহরণ:

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চরিত্র সম্পর্কে উম্মুল মুমিনিন আয়েশা রা.কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি সংক্ষিপ্ত অথচ অত্যন্ত ব্যাপক অর্থবহ শব্দে বলেন,

 كَانَ خُلُقُهُ الْقُرْأَنَ

“তাঁর চরিত্র ছিল আল-কুরআন।” অর্থাৎ কুরআন মাজিদে যে সকল উত্তম চরিত্র ও মহান নৈতিকতার উল্লেখ রয়েছে সে সবই তাঁর মাঝে বিদ্যমান ছিল। কুরআনের বর্ণিত চরিত্র অপেক্ষা উত্তম চরিত্র আর কী হতে পারে? তিনি ছিলেন পবিত্র কুরআনি চরিত্রমালার জীবন্ত প্রতীক।

◈ ৪) সেবকের পক্ষ থেকে মনিবের ব্যাপারে সাক্ষ্য:

আনাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন সব চেয়ে সুন্দর চরিত্রের অধিকারী।

একদিন তিনি আমাকে বিশেষ দরকারে এক জায়গায় যেতে বললেন। আমি বললাম, আল্লাহর কসম আমি যাব না। কিন্তু মনের মধ্যে ছিল, আল্লাহর নবী যেখানে যেতে বলেছেন আমি অবশ্যই সেখানে যাব।

যাহোক, আমি বাড়ী থেকে বের হলাম। পথিমধ্যে দেখলাম, একদল শিশু বাজারে খেলা-ধুলা করছে। (আমি দাঁড়িয়ে তাদের খেলা দেখতে লাগলাম)। হঠাৎ দেখি, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পেছন থেকে আমার কাঁধে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আর আমার দিকে তাকিয়ে হাসছেন।

তিনি বললেন: এই পিচ্চি আনাস, আমি তোমাকে যেখানে যেতে বলেছিলাম সেখানে কি গিয়েছিলে?

আমি বললাম: আমি যাব,হে আল্লাহর রাসুল।

আনাস বলেন, আমি দীর্ঘ নয় বছর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সেবা করেছি। কিন্তু আমার জানা নাই যে, কোন কাজ করে ফেললে কোন দিন তিনি আমাকে বলেছেন: কেন তুমি এ কাজটি করেছো? অথবা কখনও আমার কাজের দোষ ধরেছেন বা আমাকে কষ্টদায়ক কোন শব্দ বলেছেন।” [সহিহ মুসলিম]

◈ ৫) সুমামা রা. এর ইসলাম গ্রহণের কাহিনী:

সাহাবিগণ আরবের এক সরদারকে বন্দি করে আনলেন। তার নাম সুমামা। তারা তাকে মসজিদে (মসজিদে নববী) বেঁধে রাখলেন। খবর পেয়ে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার কাছে এসে বললেন:

: সুমামা, তোমার কী খবর?

সে বলল: মুহাম্মদ, আমার খবর ভালো। যদি আমাকে হত্যা কর তবে তো একটি প্রাণ হরণ করলে। আর যদি ছেড়ে দাও তবে একজন কৃতজ্ঞ ব্যক্তিকে মুক্ত করলে। আর যদি অর্থ চাও তবে যা চাও তাই তোমাকে দেওয়া হবে।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: তোমরা সুমামাকে ছেড়ে দাও।

তাকে ছেড়ে দেওয়া হলে সে চলে গেল। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই সে গোসল করে আবার মসজিদে ফিরে আসল। এসেই বলল, “আশহাদু আল্লা-ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আব্দুহু ওয়া রাসূলুহু “আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি: আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন উপাস্য নাই এবং আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর বান্দা এবং রাসুল।”

তারপর বলল: হে মুহাম্মদ, আল্লাহর কসম করে বলছি, “আমার কাছে দুনিয়াতে আপনার চেয়ে ঘৃণিত আর কেউ ছিল না আর এখন আপনি আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তি। দুনিয়াতে আমার কাছে আপনার ধর্মের চেয়ে ঘৃণিত ধর্ম আর একটিও ছিলনা। এখন আপনার ধর্ম আমার নিকট সবচেয়ে প্রিয়। দুনিয়াতে আমার নিকট আপনার শহরের চেয়ে ঘৃণিত শহর আর একটিও ছিলনা এখন আপনার শহর আমার কাছে সব চেয়ে প্রিয়।”

অত:পর যখন সে মক্কায় আসল তখন কেউ এসে বলল: তুমি কি ধর্মত্যাগী হয়ে গেছো?

সে বলল: না, আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি।

[বুখারি ও মুসলিম। উল্লেখিত হাদিসের শব্দগুলো সহিহ মুসলিম থেকে নেওয়া হয়েছে কিছুটা সংক্ষেপ করে]।

◈ ৬) নম্র স্বভাব ও কোমল হৃদয়ের এক মহান পুরুষ:

আল্লাহ তাআলা বলেন,

فَبِمَا رَحْمَةٍ مِنَ اللَّهِ لِنْتَ لَهُمْ وَلَوْ كُنْتَ فَظًّا غَلِيظَ الْقَلْبِ لَانْفَضُّوا مِنْ حَوْلِكَ فَاعْفُ عَنْهُمْ وَاسْتَغْفِرْ لَهُمْ وَشَاوِرْهُمْ فِي الْأَمْرِ فَإِذَا عَزَمْتَ فَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُتَوَكِّلِينَ

“আল্লাহর রহমতেই আপনি তাদের জন্য কোমল হৃদয় হয়েছেন। যদি রূঢ় ও কঠিন হৃদয়ের হতেন তবে তারা আপনার চারপাশ থেকে পালিয়ে যেতো। কাজেই আপনি তাদেরকে ক্ষমা করুন, তাদের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চান এবং কাজে-কর্মে তাদের সাথে পরামর্শ করুন। অতঃপর কোন কাজের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললে আল্লাহর উপর ভরসা করুন। যারা আল্লাহর উপর ভরসা করে তিনি তাদেরকে ভালবাসেন। [সূরা আলে ইমরান: ৫৯]

◈ ৭) দয়ার মূর্ত প্রতীক:

আবু হুরায়রা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট এক ব্যক্তি এসে বলল: হে আল্লাহর রাসুল, মুশরিকদের উপর বদ দুআ করুন।

তিনি বললেন, “আমি অভিশাপ কারী হিসেবে প্রেরিত হই নি বরং প্রেরিত হয়েছি রহমত স্বরূপ।” [সহিহ মুসলিম]

◈ ৮) সবচেয়ে ঘৃণিত চরিত্র মিথ্যা বলা:

“তিনি সব চেয়ে বেশি যে জিনিসটিকে ঘৃণা করতেন তা হল, মিথ্যা বলা।” [বায়হাকী-সনদ সহিহ]

◈ ৯) অশ্লীলতা, নোংরামি ও অভিশাপ দেওয়া ঘৃণিত স্বভাব:

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অশ্লীল ভাষী, নোংরা স্বভাবের ও অভিসম্পাত কারী ছিলেন না। তিনি বলতেন, ”তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তি সবচেয়ে ভালো যার চরিত্র সব চেয়ে সুন্দর।” [বুখারি ও মুসলিম]

◈ ১০) আশাবাদী ও কল্যাণ প্রত্যাশী:

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সব সময় কল্যাণ আশা করতেন। কখনই কোন কিছুকে অশুভ বা অমঙ্গলজনক ভাবতেন না। আর তিনি সুন্দর নাম পছন্দ করতেন। [আহমদ-সনদ সহিহ]

◈ ১১) ব্যক্তিগত আক্রোশ ও প্রতিশোধ পরায়নতা:

আয়েশা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনও নিজ হাতে কাউকে আঘাত করেন নি; কোন স্ত্রীকেও নয়; চাকরকেও নয়। অবশ্য আল্লাহর পথে জিহাদের কথা ভিন্ন।

কেউ কথা বা কাজের মাধ্যমে তাঁকে কষ্ট দিলে তিনি কখনও তার প্রতিশোধ নেননি। অবশ্য আল্লাহর বিধান লঙ্ঘন করা হলে তিনি আল্লাহর উদ্দেশ্যে তার প্রতিশোধ নিতেন। [সহিহ মুসলিম]

প্রেরণা-২: উন্নত চরিত্র গঠনের মর্যাদা

নিম্নে উন্নত চারিত্রের মর্যাদা সম্পর্কে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পবিত্র মুখনিঃসৃত একগুচ্ছ মহামূল্যবান হাদিস পেশ করা হল:

১) “তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তি সব চেয়ে ভালো যার চরিত্র সব চেয়ে বেশী সুন্দর।” [বুখারি ও মুসলিম]

২) “তোমাদের মধ্যে আমার কাছে সব চেয়ে প্রিয় সেই ব্যক্তি যার চরিত্র সব চেয়ে উত্তম।” [সহিহ বুখারি]

৩) “প্রত্যেক ধর্মের বিশেষ কিছু চরিত্র রয়েছে। ইসলাম ধর্মের (স্বতন্ত্র) চরিত্র হল লজ্জা।” [ইবনে মাজাহ-সনদ হাসান]

৪) “ইমানদার ব্যক্তি উত্তম চরিত্রের মাধ্যমে নফল রোযা এবং নফল নামায আদায়কারীর সমপরিমাণ মর্যাদা লাভ করে।” [সহিহ-আবু দাউদ]

৫) পূর্ণাঙ্গ ঈমানের অধিকারীদের মধ্যে সে ব্যক্তি অন্যতম যার চরিত্র সব চেয়ে উত্তম এবং যে তার পরিবারের সাথে সব চেয়ে নম্র ব্যাবহার করে।” [তিরমিযি-তিনি হাদিসটিকে হাসান বলেছেন]

৬) “কিয়ামতের দিন উত্তম চরিত্রের চেয়ে অন্য কিছু ওজনে এত ভারী হবে না। আর আল্লাহ তাআলা নিকৃষ্ট বেহায়া লোককে ঘৃণা করেন।” [আবু দাউদ ও তিরমিযি। ইমাম তিরমিযি হাদিসটিকে হাসান বলেছেন]।

৭) “আমার কাছে সব চেয়ে প্রিয় এবং কিয়ামতের দিন আমার সবচেয়ে নিকটতম স্থানে বসবে ঐ সকল ব্যক্তিগণ যারা সুন্দর চরিত্রের অধিকারী। পক্ষান্তরে, সে সকল লোক আমার নিকট সবচেয়ে অ পছন্দনীয় এবং কিয়ামতের দিন আমার থেকে সবচেয়ে দূরে অবস্থান করবে যারা অনর্থক বেশি কথা বলে, যারা ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে কৃত্রিমতা প্রকাশ করে কথা বলে আর অহংকার করে।”

সাহাবিগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসুল, অহংকারী কারা?

তিনি বললেন, “যারা নিজেদেরকে বড় মনে করে।” (তিরমিযি-হাসান)

৮) “নেকীর কাজ হল উত্তম চরিত্র।” [সহিহ মুসলিম]

৯) “যেখানেই থাকনা কেন আল্লাহকে ভয় কর। আর গুনাহ করে ফেললে পরক্ষণেই নেকীর কাজ কর তবে গুনাহটি মুছে যাবে। আর মানুষের সাথে ভালো ব্যবহার কর।” [তিরমিযি- তিনি হাদিসটিকে হাসান বলেছেন]

১০) “উত্তম চরিত্রগুলোকে পূর্ণতা দিতেই আমাকে প্রেরণ করা হয়েছে।” [মুসতাদরাক হাকিম। তিনি হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন আর ইমাম যাহাবী তাতে সম্মতি দিয়েছেন]।

১১) (রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবিদেরকে উদ্দেশ্য করে রা. বললেন,) তোমাদেরকে বলব কি কোন ব্যক্তি জাহান্নামের জন্য হারাম বা জাহান্নামের আগুন কার জন্য হারাম?

“সে হল ঐ ব্যক্তি যে মানুষের কাছাকাছি থাকে, সহজ-সরল এবং নরম স্বভাবের।” [মুসনাদ আহমদ, তিরমিযি। আলবানি এ হাদিসের সমার্থবোধক একাধিক হাদিসের আলোকে এটিকে সহিহ বলেছেন]

১২) “ঐ ব্যক্তি আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় বান্দা যার চরিত্র সবচেয়ে সুন্দর।” [মুসতাদরাক হাকেম-আলবানি হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন]

১৩) “তারাই পূর্ণাঙ্গ ঈমানের অধিকারী যাদের চরিত্র সব চেয়ে সুন্দর। যারা তাদের কাঁধ নত রাখে অর্থাৎ যারা বিনয়ী ও নম্র-ভদ্র আর মানুষের সাথে বন্ধুত্ব রাখে, মানুষও তাদের সাথে বন্ধুত্ব রাখে। যে ব্যক্তি কারও সাথে বন্ধুত্ব রাখে না এবং মানুষও যার সাথে বন্ধুত্ব রাখে না তার মধ্যে কোন কল্যাণ নেই।” [ত্ববারানী, আলবানি এটিকে হাসান বলেছেন]

১৪) রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে প্রশ্ন করা হল, কোন জিনিসটি মানুষকে সবচেয়ে বেশি জান্নাতে প্রবেশ করাবে? তিনি বললেন, “আল্লাহর ভয় এবং উত্তম চরিত্র।” [তিরমিযি। সমার্থবোধক একাধিক হাদিসের আলোকে এ হাদিসটি সহিহ]

১৫) “মুমিন ব্যক্তি হয় সহজ-সরল এবং আত্ম মর্যাদা সম্পন্ন। আর পাপাচারী ব্যক্তি হয় প্রতারক ও নিচু স্বভাবের।” [আহমদ প্রমুখ। আলবানি হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন]

১৬) “মুমিন ব্যক্তিরা হবে পোষা উটের মত সহজ-সরল এবং নরম প্রকৃতির। তাকে যে দিকেই টানা হয় সে দিকেই বাধ্যগত হয়ে চলে। এমনকি শক্ত পাথরের উপর বসতে নির্দেশ দেওয়া হলে সে নির্দেশ পালন করে।” অর্থাৎ ইমানদার ব্যক্তি হবে ইসলামের আদেশ-নিষেধগুলোর প্রতি পরম অনুগত)” [তিরমিযি। মিশকাতুল মাসাবিহ-এর তাহকিক গ্রন্থে আলবানি বলেন, হাদিসটি হাসান লি গাইরিহী]

১৭) “যে ইমানদার ব্যক্তি মানুষের সাথে মিলামিশা করে এবং কেউ কষ্ট দিলে তাতে ধৈর্যের পরিচয় দেয় সে ঐ ব্যক্তি থেকে উত্তম যে কারও সাথে উঠবস করে না আর কেউ কষ্ট দিলে তাতে ধৈর্য ধারণ করে না।” [মুসনাদ আহমদ। ইবনুল হাজার রহ. ফাতহুল বারী কিতাবে হাদিসটিকে হাসান বলেছেন]

১৮) রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবিদের লক্ষ্য করে রা. বললেন, “আমি কি তোমাদেরকে বলব যে, তোমাদের মধ্যে কে সব চেয়ে উত্তম?”

সাহাবিগণ রা. বললেন, জি হ্যাঁ, বলুন।

তিনি বললেন, “তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তিই সব চেয়ে উত্তম যে দীর্ঘ জীবন লাভ করার পাশাপাশি সুন্দর চরিত্রের অধিকারী হয়।” [আহমদ। আলবানি বলেন, হাদিসটির সনদ হাসান লি গাইরিহী]

১৯) “তোমার মধ্যে যদি চারটি গুণ থাকে তবে তোমার কাছে দুনিয়ার অন্য কিছু না থাকলেও তাতে কোন অসুবিধা নাই। সত্য কথা, আমানত রক্ষা, সুন্দর আচার-ব্যবহার এবং পবিত্র খাবার।” [মুসনাদ আহমদ প্রমুখ। আলবানি সিলসিলা কিতাবে হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন]

২০) “আল্লাহ তো আমাকে এ জন্য প্রেরণ করেন নি যে, আমি মানুষকে কষ্ট দিব বা খুঁজে খুঁজে কষ্টসাধ্য ও জটিল জিনিসগুলো তাদের উপর চাপিয়ে দিব বরং প্রেরণ করেছেন মানুষকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য এবং জটিলতা মুক্ত করার জন্য।” [সহিহ মুসলিম]

২১) “আমি ঐ ব্যক্তির জন্য জান্নাত সংলগ্ন একটি ঘরের জামিনদার হব যে ব্যক্তি ঝগড়া-বিবাদ বর্জন করে যদিও সে ন্যায়ের উপর থাকে। আর ঐ ব্যক্তির জন্য জান্নাতের মধ্যস্থিত একটি ঘরের জামিনদার হব যে মিথ্যা কথা পরিত্যাগ করে যদিও কৌতুকের ছলে হয়। আর ঐ ব্যক্তির জন্য জান্নাতের উপরিভাগে একটি ঘরের জামিনদার হব যে তার চরিত্র সুন্দর করে।” [আবু দাউদ। আলবানি হাদিসটিকে হাসান বলেছেন]

প্রেরণা-৩: উন্নত চরিত্রের জন্য হৃদয় নিংড়ানো একগুচ্ছ দুআ

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উত্তম চরিত্রের জন্য যেভাবে দুআ করেছেন:

১)

اللَّهُمَّ اهْدِنِي لأَحْسَنِ الأَعْمَالِ وَأَحْسَنِ الأَخْلاقِ ، فَإِنَّهُ لا يَهْدِي لأَحْسَنِهَا إِلا أَنْتَ ، وَقِنِي سَيِّءَ الأَعْمَالِ وَسَيِّءَ الأَخْلاقِ ، فَإِنَّهُ لا يَقِي سَيِّئَهَا إِلا أَنْتَ

“হে আল্লাহ, আমাকে সর্বোত্তম কাজ ও উন্নততর চরিত্রের দিশা দাও। কেননা, তুমি ছাড়া এ পথের দিশা অন্য কেউ দিতে পারে না। আর অন্যায় কাজ ও খারাপ চরিত্র থেকে আমাকে রক্ষা কর। কেননা, তুমি ছাড়া অন্য কেউ এ থেকে রক্ষা করতে পারে না।” [সুনান নাসাঈ। আরনাবুত জামিউল উসুল কিতাবে এ হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন।]

২) اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ مُنْكَرَاتِ الْأَخْلَاقِ، وَالْأَعْمَالِ، وَالْأَهْوَاءِ والْأَدْوَاءِ

 “হে আল্লাহ তোমার কাছে খারাপ চরিত্র, অন্যায় কাজ, কু প্রবৃত্তি এবং দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে আশ্রয় চাই।” [তিরমিযি-আলবানি হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন]

৩) اللَّهُمَّ أَلِّفْ بَيْنَ قُلُوبِنَا، وَأَصْلِحْ ذَاتَ بَيْنِنَا

“হে আল্লাহ,আমাদের হৃদয়গুলোর মাঝে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি কর আর আমাদের (বিবদমান বিষয়গুলো) সমাধান করে দাও।” [সহিহ বুখারি]

৪) اللَّهُمَّ إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ فَأَيُّ الْمُسْلِمِينَ لَعَنْتُهُ أَوْ سَبَبْتُهُ فَاجْعَلْهُ لَهُ زَكَاةً وَأَجْرًا

“হে আল্লাহ, আমি তো একজন মানুষ মাত্র। সুতরাং আমি কোন মুসলিমকে গালি বা অভিশাপ দিয়ে থাকলে সেটাকে তুমি তাকে (গুনাহ থেকে) পবিত্র করার মাধ্যম বানিয়ে দাও এবং তাকে তার বিনিময় দাও।” [সহিহ মুসলিম]

৫) « اللَّهُمَّ مَنْ وَلِىَ مِنْ أَمْرِ أُمَّتِى شَيْئًا فَشَقَّ عَلَيْهِمْ فَاشْقُقْ عَلَيْهِ وَمَنْ وَلِىَ مِنْ أَمْرِ أُمَّتِى شَيْئًا فَرَفَقَ بِهِمْ فَارْفُقْ بِهِ »

“হে আল্লাহ কেউ আমার উম্মতের কোন বিষয়ে দায়িত্বশীল হয়ে যদি তাদের সাথে কঠিন আচরণ করে তবে তুমিও তার সাথেও কঠিন আচরণ কর । আর কেউ কোন বিষয়ে দায়িত্বশীল হয়ে যদি তাদের সাথে নম্রতা সুলভ আচরণ করে তার প্রতি তুমিও তার প্রতি দয়া পরবশ হও।” [সহিহ মুসলিম]

৬) اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ عِلْمٍ لاَ يَنْفَعُ، وَعَمَلٍ لاَ يُرْفَعُ، وَقَلَبٍ لاَ يَخْشَعُ، وَقَولٍ لاَ يُسْمَعُ

“হে আল্লাহ, তোমার নিকট আশ্রয় চাই এমন জ্ঞান থেকে যা কোন উপকার করে না, এমন আমল থেকে যা উপরে উঠানো হয় না, এমন অন্তর থেকে যা ভীত হয় না এবং এমন কথা থেকে যা শোনা হয় না।” [সহিহ মুসলিম]

৭) اللَّهُمَّ كَمَا حَسَّنْتَ خَلْقِي فَأَحْسِنْ خُلُقِي

“হে আল্লাহ, তুমি আমার দৈহিক অবয়ব যেমন সুন্দর করেছো তেমনি আমার চরিত্রকেও সুন্দর করে দাও।” [মুসনাদ আহমদ। আলবানি মিশকাতুল মাসাবীহ কিতাবে হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন। হাদিস নং ৫০৯৯]

প্রেরণা-৪: ক্ষমা এক মহৎ গুণের নাম

১) আবু বকর রা. এর ঘটনা:

আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত। এক লোক এসে আবু বকর রা.কে বকাবকি করতে লাগল। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেখানেই বসে ছিলেন। তিনি এ কাণ্ড দেখে আশ্চর্য হয়ে মুচকি মুচকি হাসছেন। লোকটি বেশি মাত্রায় বকাবকি শুরু করলে আবু বকর তার দু একটি কথার জবাব দিলেন। এতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাগ করে সেখান থেকে উঠে চলে গেলেন।

আবু বকর পেছনে পেছনে গিয়ে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট উপস্থিত হয়ে রা. বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, লোকটি আমাকে বকাবকি করছিল আর আপনি সেখানে বসে ছিলেন। কিন্তু যখনই তার কিছু কথার জবাব দিলাম আপনি রেগে সেখান থেকে চলে আসলেন!!

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম: তোমার সাথে একজন ফেরেশতা ছিল যে তোমার পক্ষ থেকে উত্তর দিচ্ছিল। আর যখনই তুমি উত্তর দিলে সেখানে শয়তান ঢুকে পড়ল।

আর হে আবু বকর, তিনটি জিনিস খুবই সত্য:

ক. কেউ কোন ব্যাপারে জুলুমের শিকার হওয়ার পর সে যদি আল্লাহর উদ্দেশ্যে তা ক্ষমা করে দেয় তবে এর বিনিময়ে আল্লাহ তাআলা তাকে সম্মান জনক ভাবে সাহায্য করেন।

খ. কেউ যদি (কোন আত্মীয়ের সাথে বা সাধারণ মুসলমানের সাথে) সুসম্পর্ক তৈরির উদ্দেশ্যে দানের রাস্তা খুলে তবে আল্লাহর তার সম্পদ আরও বৃদ্ধি করে দেন।

গ. আর কেউ যদি সম্পদ বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে মানুষের কাছে ভিক্ষার দরজা উন্মুক্ত করে তবে আল্লাহ তাআলা তার সম্পদ কমিয়ে দেন। [মুসনাদ আহমদ,আলবানি বলেন, হাদিসটি হাসান। মিশকাত হাদিস নং ৫১০]

২) শুরু যার অপরাধ তার

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “দু জন লোক যদি পরস্পরকে গালাগালি করে তবে যাবতীয় গুনাহ তার উপর বর্তাবে যে আগে শুরু করেছে যদি অত্যাচারিত ব্যক্তি প্রতিদত্তরে অতিরিক্ত না বলে।” [সহিহ মুসলিম]

এ হাদিসের আলোকে প্রমাণিত হয় যে, যে ব্যক্তি আগে কাউকে কষ্ট দেয় বা গালি দেয় তবে তার সমপরিমাণ প্রতিদত্তর দেওয়া জায়েজ আছে আর তার যাবতীয় গুনাহ যে আগে শুরু করেছে তার উপর বর্তাবে। কারণ, সেই এর মূল কারণ। অবশ্য যদি প্রতিদত্তরে সে অতিরিক্ত গালমন্দ করে তবে যে পরিমাণ অতিরিক্ত গালমন্দ করেছে তার জন্য গুনাহগার হবে। কারণ,ইসলামে কেবল সমপরিমাণ প্রতিশোধ নেওয়ার অনুমোদন রয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَجَزَاءُ سَيِّئَةٍ سَيِّئَةٌ مِّثْلُهَا ۖ فَمَنْ عَفَا وَأَصْلَحَ فَأَجْرُهُ عَلَى اللَّـهِ ۚ إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الظَّالِمِينَ

“অন্যায়ের প্রাপ্য শুধু সমপরিমাণ অন্যায়। তবে যে ব্যক্তি ক্ষমা করে দেয় এবং সমঝোতা করে সে আল্লাহর নিকট পুরস্কার প্রাপ্ত হবে। তিনি তো অত্যাচারীদেরকে পছন্দ করেন না। [সূরা শূরা: ৪০]

যদিও সমপরিমাণ প্রতিশোধ নেওয়া জায়েজ আছে তবুও ধৈর্য ধারণ করা উত্তম। যেমনটি আবু হুরায়রা রা. কর্তৃক বর্ণিত পূর্বোক্ত হাদিসটিতে বর্ণিত হয়েছে।

৩) ঝগড়াটে স্বভাবের মানুষ ঘৃণিত:

“প্রচণ্ড ঝগড়াটে স্বভাবের লোক আল্লাহর নিকট খুবই ঘৃণিত।” [বুখারি ও মুসলিম]

প্রেরণা-৫: বিনয়ের অপূর্ব দৃষ্টান্ত

১) আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ لِلْمُؤْمِنِينَ

“তোমার বাহুকে নত করে দাও ঐ সকল মুমিনদের জন্য যারা আপনাকে অনুসরণ করে।” [সূরা হিজর: ৮৮]

২) ছোট্ট শিশু আবু উমাইরের ঘটনা:

আনাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন সবচেয়ে সুন্দর চরিত্রের অধিকারী। আমার ছোট একটি ভাই ছিল যার নাম আবু উমাইর। সে তখনো দুধ পান করত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখনই আমাদের বাড়িতে আসতেন তখনই তাকে লক্ষ্য করে বলতেন, “হে আবু উমাইর, কি করল তোমার নুগাইর?” কারণ তার একটি পাখি ছিল যার নাম,নুগার। সে এটা নিয়ে খেলাধুলা করত। তাই তাকে আনন্দ দেওয়ার জন্য তিনি পাখিটির কথা তাকে বলতেন। (পাখিটি দেখতে অনেকটা চড়ুই পাখির মত)। [বুখারি ও মুসলিম]

৩) বাড়িতে থাকা কালীন তিনি গৃহস্থালির কাজ-কাম করতেন:

প্রখ্যাত তাবেঈ আসওয়াদ ইবনে ইয়াজিদ হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি আয়েশা রা. কে জিজ্ঞেস করলাম, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বাড়িতে থাকা কালীন সময় কী কাজ করতেন?

তিনি বললেন, গৃহস্থালির কাজ-কাম করতেন। নামাযের সময় হলে ওযু করে মসজিদে যেতেন। [বুখারি ও মুসলিম]

৪) একটি ছোট্ট মেয়ে শিশু সাথে আচরণ:

 আনাস রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, কোন ছোট মেয়ে এসেও যদি তাঁর হাত ধরত তিনি তাকে সাথে নিয়ে তার ইচ্ছামত চলতেন। [সহিহ বুখারি]

৫) সম্মান প্রর্দশনার্থে দাঁড়ানো নিষেধ:

আনাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, সাহাবিদের নিকট রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর চেয়ে অধিক প্রিয় আর কেউ ছিল না। তারপরও তাঁকে আসতে দেখলে সাহাবিগণ দাঁড়াতেন না। কারণ তাঁরা জানতেন যে, তিনি তা পছন্দ করেন না। [আহমদ ও তিরমিযি। সনদ সহিহ]

৬) অতিরিক্ত প্রশংসা করা নিষেধ:

 রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “তোমরা আমার অতিরিক্ত প্রশংসা কর না যেমন খৃষ্টানরা মরিয়মের পুত্র ঈসার প্রশংসা করতে গিয়ে সীমালঙ্ঘন করেছিল। আমি তো কেবল একজন বান্দা মাত্র। অতএব তোমরা আমাকে বল, আল্লাহর বান্দা এবং তাঁর রাসুল।” [সহিহ বুখারি]

৭) বাচ্চাদেরকে সালাম প্রদান:

তিনি আনসারী সাহাবিদের সাথে দেখা-সাক্ষাত করতে গেলে ছোট ছোট বাচ্চাদেরকেও সালাম দিতেন এবং তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন। (নাসাঈ, সনদ সহিহ)

৯) “কেউ তাঁর নিকট কিছু চাইলে তিনি তাকে তা দিতেন অথবা চুপ থাকতেন।” [হাকেম-সহিহ]

৯) সামাজিক কাজে অংশ গ্রহণ:

 তিনি দুর্বল অসহায় মুসলিমদের সাথে দেখা করত যেতেন। কেউ অসুস্থ হলে সেবা-শুশ্রূষা করতেন এবং মৃত্যু বরণ করলে জানাজায় উপস্থিত হতেন। [আবু ইয়ালা-সহিহ]

১০) শ্রেষ্ঠ নেতার উদাহরণ

 তিনি কাফেলার পেছনে চলতেন এবং দুর্বল লোককে তার আরোহীর পেছনে উঠিয়ে সাথে করে নিয়ে আসতেন এবং তাদের জন্য দুআ করতেন। [আবু দাউদ-সহিহ]

১১) এক অসাধারণ অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব

তিনি বেশি বেশি জিকির করতেন। অহেতুক কাজ খুব কম করতেন। নামায দীর্ঘ করতেন। বক্তৃতা সংক্ষেপ করতেন। যে কোন দরকারে বিধবা, গরীব-মিসকিন এবং দাস ও চাকর-বকরের সাথে যেতে ঘৃণা করতেন না বা অহংকার করতেন না। [সুনান নাসাঈ-সহিহ]

১২) সহজ-সরল জীবনের প্রতিচ্ছবি

 তিনি মাটির উপর বসতেন। মাটির উপর বসে খানা খেতেন। বকরী দোহন করতেন বা জবেহ করতেন এবং কোন দাসও যদি যবের রুটি খাওয়ার দাওয়াত দিত তবেও তিনি তাতে অংশ গ্রহণ করতেন। [সুনান নাসাঈ-সহিহ]

১৩) তাঁর নিকট থেকে মানুষকে ঠেলে দূরে সরানো হত না বা চলে যেতে যেতে বাধ্য করা হত না। [ত্ববারানী-সহিহ]

১৪) কেউ সুগন্ধি উপহার দিলে তা ফেরাতেন না। [সহিহ বুখারি]

১৫) স্ত্রীর সাথে কৌতুক:

 তিনি (মাঝে-মধ্যে) তাঁর স্ত্রী উম্মে সালামা যায়নব এর সাথে কৌতুক করে বলতেন: “হে যুওয়াইনাব,হে যুওয়ইনাব” অনেকবার তিনি এরূপ বলতেন। [যিয়া-সহিহ]

১৬) পায়ে হেঁটে পথ চলা:

 জাবের রা. বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং আবু বকর রা. আমার নিকট পায়ে হেঁটে আগমন করেছিলেন। [সহিহ বুখারি]

১৭) শিশুদের প্রতি সালাম:

আনাস রা. বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিছু সংখ্যক শিশুর নিকট দিয়ে যাওয়ার সময় তাদেরকে সালাম দিলেন। [সহিহ মুসলিম]

১৮) একজন সাংসারিক মানুষ

আয়েশা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জুতা মেরামত করতেন, কাপড় সেলাই করতেন এবং আপনারা যেভাবে বাড়িতে গৃহস্থালির কাজ-কাম করে থাকেন তেমনি তিনিও বাড়িতে গৃহস্থালির কাজ-কাম করতেন। তিনি মানব সমাজের মধ্য থেকে একজন মানুষ ছিলেন। তিনি কাপড়ে উকুন খুঁজতেন, বকরীর দুধ দোহন করতেন এবং নিজের কাজ নিজেই করতেন। (সুনান তিরমিযি, সহিহ-আলবানি)

১৯) সেবকের মুখে মালিকের প্রশংসা

আনাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমার বয়স যখন মাত্র আট বছর তখন থেকেই আমি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সেবা করেছি। কিন্তু কোন জিনিস নষ্ট করে ফেললে তিনি কখনই আমাকে তিরস্কার করেননি। বরং তার পরিবারের কেউ তিরস্কার করলে বলতেন, তাকে ছাড়, আল্লাহর পক্ষ থেকে যা ফয়সালা হয় সেটাই হয়। [বায়হাকি, আলবানি হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন।]

প্রেরণা-৬: বিনয়ী ও অহংকার মুক্ত জীবনের নির্দেশিকা

১) বিনয়ী হওয়ার আসমানি ফরমান:

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “আল্লাহ তাআলা আমাকে ওহীর মারফত এ নির্দেশ দিয়েছেন যে, তোমরা বিনয়ী হও। কেউ যেন কারও উপর অহংকার না করে এবং কেউ যেন কারও ব্যাপারে বাড়াবাড়ি না করে।” [সহিহ মুসলিম]

২) বিনয় মর্যাদা বাড়ায়

তিনি বলেন, “দান করলে সম্পদ কমে না। ক্ষমা করলে আল্লাহ বান্দার মর্যাদা বাড়িয়ে দেন। কেউ আল্লাহর উদ্দেশ্যে বিনয়ী হলে তিনি তাকে সম্মানের উঁচু আসনে স্থান দেন।” [সহিহ মুসলিম]

৩) অহংকার মুক্ত জীবনের প্রতীক

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:

“আমাকে যদি ছাগলের পাঁজরের হাড্ডি বা টাখনুর নিম্নাংশ খাওয়ার জন্য ডাকা হয় তবে তাতেও সাড়া দিব এবং কেউ যদি ছাগলের পাঁজরের হাড্ডি বা টাখনুর নিম্নাংশ উপহার দেয় তবুও তা গ্রহণ করব।” [সহিহ বুখারি]

৪) কখনো উত্থান কখনও পতন

আনাস রা. বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর একটি উটনি ছিল (সেটার নাম আযবা) যাকে দৌড় প্রতিযোগিতায় কেউ হারাতে পারত না বা হারানো খুব কঠিন হত। একবার এক বেদুঈন একটি উটে আরোহন করে আসল এবং দৌড় প্রতিযোগিতায় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উটের অগ্রগামী হয়ে গেল। এতে মুসলিমগণ খুব কষ্ট পেল। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের মানসিক অবস্থা বুঝতে পেরে রা. বললেন, “আল্লাহর অধিকার আছে যে, দুনিয়ার কোন জিনিস উপরে উঠে গেলে তিনি তাকে নিচে নামিয়ে দিবেন।” [সহিহ বুখারি]

৫) সময় পরিবর্তনশীল

সময় পরিবর্তনশীল। সময়ের ব্যবধানে মানুষের জীবনে পরিবর্তন আসতে পারে। তাই কারো বর্তমান অবস্থা দেখে ভবিষ্যতবাণী করা ঠিক নয়। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বাল্যকালে যখন মক্কার মাঠে-ময়দানের সামান্য গম বা জবের বিনিময়ে বকরীর রাখালি করতেন তখন কে ভেবেছিলি এই ছেলেই একদিন বিশ্বজয়ী নেতা হবে? হবেন আল্লাহর প্রেরিত সর্বশ্রেষ্ঠ পয়গম্বর?

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রা. বললেন, আল্লাহ এমন কোন নবী পাঠান নি যিনি বকরী চরাননি।

সাহাবিগণ রা. বললেন, আপনিও?

তিনি বললেন, “হ্যাঁ। আমিও কয়েক কিরাত গম বা জবের বিনিময়ে মক্কাবাসীদের বকরী চরিয়েছি।” [সহিহ বুখারি]

৬) আঙ্গুল চুষে খাওয়া অভদ্রতা নয় বরং বিনয়ের প্রমাণ

আনাস রা. বলেন, তিনি কোন খাবার খেলে তিনটি আঙ্গুল চুষে খেতেন আর বলতেন, “তোমাদের কারও খাবার লোকমা পড়ে গেলে সে যে তা তুলে নেয়। তা যেন শয়তানের জন্য ফেলে না রাখে পরিষ্কার করে খেয়ে নেয়।”

আনাস রা. বলেন, তিনি আমাদেরকে খাবার প্লেট মুছে খেতে নির্দেশ দিতেন (অর্থাৎ এমনভাবে খেতে নির্দেশ দিতেন যেন প্লেটের কোথাও খাবার পড়ে না থাকে।) আর বলতেন, “তোমাদের তো জানা নেই যে,খাদ্যের কোন অংশে বরকত রয়েছে।” [সহিহ মুসলিম]

প্রেরণা-৭: অহংকারীদের পরিণতি

১) দুর্বলের এত অহংকার কেন?

আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَلَا تَمْشِ فِي الْأَرْضِ مَرَحًا ۖ إِنَّكَ لَن تَخْرِقَ الْأَرْضَ وَلَن تَبْلُغَ الْجِبَالَ طُولًا

“অহংকার করে জমিনে চলা ফেরা কর না। কারণ, তুমি তো (পায়ের আঘাতে) মাটি বিদীর্ণ করতে পারবেনা বা দৈর্ঘ্যে পাহাড়ের সমানও হতে পারবে না।” [সূরা ইসরা: ৩৭ ও ৩৮]

২) তোমার আচরণ তোমার ব্যক্তিত্বের পরিচায়ক

আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,

وَلَا تُصَعِّرْ خَدَّكَ لِلنَّاسِ وَلَا تَمْشِ فِي الْأَرْضِ مَرَحًا ۖ إِنَّ اللَّـهَ لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ – وَاقْصِدْ فِي مَشْيِكَ وَاغْضُضْ مِن صَوْتِكَ ۚ إِنَّ أَنكَرَ الْأَصْوَاتِ لَصَوْتُ الْحَمِيرِ

“চলা ফেরায় মধ্যম পন্থা অবলম্বন কর এবং আওয়াজ নিচু করে কথা বল। নিশ্চয় সবচেয়ে অ পছন্দনীয় আওয়াজ হল গাধার আওয়াজ।” [সূরা লোকমান: ১৯-১৮]

৩) অহংকার সাজে কেবল আল্লাহর:

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আল্লাহ বলেন, “মর্যাদা আমার লুঙ্গি আর অহংকার আমার চাদর। কেউ এ দুটির কোন একটি নিয়ে টানাটানি করলে তাকে আমি আযাবে নিক্ষেপ করব।” (হাদিস কুদসী-সহিহ মুসলিম)

হাদিসের ব্যাখ্যা:

এ হাদিসে কুদসীতে মর্যাদাকে লুঙ্গি আর অহংকারকে চাদরের সাথে তুলনা করা হয়েছে। কারণ, যে ব্যক্তি মর্যাদা ও অহংকার করে সে যেন এ দুটি জিনিসকে তার শরীরে জড়িয়ে রাখে যেমন লুঙ্গি ও চাদর দ্বারা মানুষ নিজ শরীরকে আবৃত করে রাখে। তবে এগুলো পরিধানের ক্ষেত্রে তার সাথে অন্য কেউ শরিক হয় না। ঠিক তেমনি মর্যাদা ও অহংকার আল্লাহ তাআলার লুঙ্গি ও চাদর। সুতরাং এ গুলোতে আল্লাহর সাথে অংশ গ্রহণ করা কারও জন্য শোভনীয় নয়। তাই উপরোক্ত উদাহরণ পেশ করা হয়েছে। আর সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ তো আল্লাহ তাআলার প্রাপ্য। [ইবনুল আসীর-জামিউল উসুল]

৪) সুন্দর জুতা-জামা পড়া অহংকার নয়:

 “যার মনে বিন্দু মাত্র অহংকার রয়েছে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।” এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, মানুষ তো চায় তার জামা-কাপড় সুন্দর হোক, জুতা সুন্দর হোক। তিনি বললেন, আল্লাহ নিজে সুন্দর। তিনি সৌন্দর্যকে পছন্দ করেন। অহংকার হল, সত্য প্রত্যাখ্যান করা এবং মানুষকে হেয় মনে করা। [সহিহ মুসলিম]

অন্য বর্ণনায় এসেছে: “যার অন্তরে সরিষা পরিমাণ ঈমান আছে সে জাহান্নামে যাবে না। আর যার অন্তরে সরিষা পরিমাণ অহংকার আছে সে জান্নাতে যাবে না।” [সহিহ মুসলিম]

হাদিসটির অর্থ: ইমাম নববী রহ. সহিহ মুসলিমের ব্যাখ্যা গ্রন্থে বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:

“যার অন্তরে সরিষা পরিমাণ অহংকার আছে সে জান্নাতে যাবে না।” এ কথাটির অর্থ হল, সে ব্যক্তি মুত্তাকী-পরহেজগার লোকদের সাথে প্রথম পর্যায়ে জান্নাতে যাবে না। বরং আল্লাহ তাআলা তার ব্যাপারে নিরীক্ষণ করে হয় শাস্তি দিবেন অথবা মাফ করে দিবেন।

“যার অন্তরে সরিষা পরিমাণ ঈমান আছে সে জাহান্নামে যাবে না।” এ কথাটির অর্থ হল, সে চিরস্থায়ীভাবে থাকার জন্য জাহান্নামে যাবে না। (বরং সারা জীবনের পাপাচারের শাস্তি ভোগ করার পর তার অন্তরে সামান্যতম ঈমান থাকার কারণে জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ করবে)। [ইবনুল আসীর জামিউল আসার কিতাবে এ কথা উল্লেখ করেছেন]।

৫) অহংকারীদের কঠিন পরিণতি:

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “দুনিয়াতে যারা অহংকার করতো কিয়ামতের দিন তাদের হাশর হবে মানুষ আকৃতিতে ভুট্টার দানার মত অতি ক্ষুদ্রকায় অবস্থায়। তাদেরকে চারিদিক থেকে লাঞ্ছনা ও তিরস্কার ঘিরে ধরবে। এমতাবস্থায় জাহান্নামের জেলখানার দিকে তাদেরকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। (সে জেলখানাটির নাম বুলিস)। আনিয়ার নামক আগুন এসে তাদেরকে গ্রাস করবে আর পাপচারী জাহান্নামীদের রক্ত-পুঁজ তাদেরকে পান করানো হবে।” (তিরমিযি। তিনি হাদিসটিকে হাসান বলেছেন আর জামিউল উসুল কিতাবের গবেষক এতে ঐকমত্য প্রকাশ করেছেন)।

৬) মাটির তৈরি মানুষের কীসের এত অহংকার?

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “আল্লাহ তাআলা তোমাদের থেকে জাহেলিয়াতের মূর্খতা সুলভ অহংকার এবং বাপ-দাদা নিয়ে পরস্পর বড়ত্ব দেখানোর কুপ্রথা দূরভিত করেছেন। মানুষ দু ভাগে বিভক্ত: এক শ্রেণীর মানুষ সৎ-ইমানদার-পরহেজগার। আর এক শ্রেণী হতভাগ্য পাপাচারী। সকল মানুষই আদমের সন্তান। আর আদমকে সৃষ্টি করা হয়েছে মাটি থেকে।” (তিরমিযি। তিনি হাদিসটিকে হাসান বলেছেন আর জামিউল উসুল কিতাবের গবেষক এতে ঐকমত্য প্রকাশ করেছেন)।

৫) ভূমিধ্বসের কবলে এক অহংকারী

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “(আগের যুগের ঘটনা) এক ব্যক্তি রাস্তা ধরে হাঁটছিল। পরনে ছিল দুটি সুন্দর পোশাক যেগুলো দেখে সে আত্ম অহমিকায় ভুগছিল। মাথা ছিল পরিপাটি করে আঁচড়ানো। পথ চলছিল অহংকারের সাথে। এমতাবস্থায় আল্লাহ তাআলা তাকে ভূমি ধ্বসের কবলে নিক্ষেপ করলেন। ফলে কিয়ামত পর্যন্ত সে মাটির নিচে ঢুকতেই থাকবে।” [বুখারি ও মুসলিম]

প্রেরণা-৮: ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা

১) আল্লাহ তাআলা বলেন,

خُذِ الْعَفْوَ وَأْمُرْ بِالْعُرْفِ وَأَعْرِضْ عَنِ الْجَاهِلِينَ

“ক্ষমার নীতি অবলম্বন করুন, ভালো কাজের আদেশ করুন আর মূর্খদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিন।” [সূরা আরাফ: ১৯]

২) আঘাত পেয়েও হাসেন তিনি:

আনাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাথে পথ চলছিলাম। তাঁর গায়ে ছিল একটি নাজরানী চাদর। যার পার্শ্বদেশগুলো ছিল মোটা। হঠাৎ এক বেদুঈন এসে তার চাদর ধরে খুব জোরে টান দিল। আর (চাদর গা থেকে সরে যাওয়ায়) আমি তাঁর ঘাড়ের শুভ্রতা দেখতে পেলাম। খুব জোরে টানার কারণে চাদরের পার্শ্বদেশের ঘর্ষণে তার ঘাড়ে দাগ পড়ে গিয়েছিল।

লোকটি এবার বলল: হে মুহাম্মদ, তোমার কাছে আল্লাহর যে সমস্ত সম্পদ আছে সেখান থেকে কিছু সম্পদ আমাকে দিতে বল। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। অতঃপর লোকটিকে দেওয়ার জন্য আদেশ করলেন। [বুখারি ও মুসলিম]

৩) দুটি খুব পছন্দনীয় গুণ:

ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আশাজ্জ আব্দুল কায়স রা. কে রা. বললেন, আপনার মধ্যে দুটি স্বভাব আছে যেগুলো আল্লাহ তাআলা ভালবাসেন। সে দুটি হল, ধৈর্য এবং ধীরস্থিরতা। [সহিহ মুসলিম]

৪) তলোয়ার নিচেও মহান আল্লাহর প্রতি পরম আস্থা ও সীমাহীন নির্ভরতা:

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন এক সফরে যাত্রা বিরতি করে এক গাছের নিচে এসে অবস্থান নিলেন এবং গাছে তাঁর তলোয়ারটি ঝুলিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলে দেখলেন পাশেই এক লোক দাঁড়িয়ে আছে। কখন যে সে এসেছে তিনি বিন্দুমাত্র টের পাননি।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, লোকটি (ইতোমধ্যে) আমার তরবারির খাপ থেকে তরবারি বের করে নিয়েছে।

এবার সে বলল: তোমাকে আমার হাত থেকে এখন কে বাঁচাবে?

আমি বললাম: আল্লাহ।

একথা শুনে সে তরবারি আবার খাপের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বসেই থাকলেন। তাকে কোন শাস্তি দিলেন না।

[বুখারি ও মুসলিম। তবে এহাদিসটির মূল ভাষা নেওয়া হয়েছে সহিহ বুখারি থেকে]

প্রেরণা-৯: রাগ নিয়ন্ত্রণ

১) রাগে ক্ষমাকারীর জন্য আল্লাহর প্রশংসা

 আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَالَّذِينَ يَجْتَنِبُونَ كَبَائِرَ الْإِثْمِ وَالْفَوَاحِشَ وَإِذَا مَا غَضِبُوا هُمْ يَغْفِرُونَ

“আর যারা বড় ধরণের গুনাহ এবং অশ্লীল কার্যক্রম থেকে বিরত থাকে আর যখন রাগ করে ক্ষমা করে দেয়।” [সূরা শুরা ৩৭]

২) রাগ নিয়ন্ত্রণকারীর ব্যাপারে আল্লাহর প্রশংসা

আল্লাহ আরও বলেন,

الَّذِينَ يُنفِقُونَ فِي السَّرَّاءِ وَالضَّرَّاءِ وَالْكَاظِمِينَ الْغَيْظَ وَالْعَافِينَ عَنِ النَّاسِ ۗ وَاللَّـهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ

“যারা সুখে-দুখে আল্লাহর পথে ব্যয় করে, রাগ দমন করে আর মানুষকে ক্ষমা করে। যারা সৎকর্ম করে আল্লাহ তাদেরকে ভালবাসেন।” [সূরা: আলে ইমরান: ১৩৪]

৩) রাগ দমনের মর্যাদা:

 “যে ব্যক্তি রাগকে দমন করবে অথচ তা সে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম ছিল। তাহলে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা তাকে সমস্ত সৃষ্টি জীবের সামনে আহবান করে তার ইচ্ছেমত যে কোন হুর গ্রহণ করার অনুমতি দিবেন।” [তিরমিযি ও আবু দাউদ, আলবানি মিশকাতে হাদিসটিকে হাসান বলেছেন]

৪) আসল বীর:

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “কুস্তি লড়ায়ে পরাস্ত কারী প্রকৃত বীর নয় বরং প্রকৃত বীর সে ব্যক্তি যে রাগের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। [বুখারি ও মুসলিম]

৫) ব্যক্তিগত আক্রোশে প্রতিশোধ:

আয়েশা রা. বলেন, “রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ব্যক্তিগত কারণে কখনই প্রতিশোধ নেননি। তবে আল্লাহর সীমা লঙ্ঘন হলে আল্লাহর উদ্দেশ্যে তার প্রতিশোধ নিতেন।” [বুখারি ও মুসলিম]

৬) রাগ করো না:

এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট এসে বলল: আমাকে কিছু উপদেশ দিন। কিন্তু বেশি যেন না হয় তবে হয়ত তা মুখস্থ রাখতে পারব। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রা. বললেন, “তুমি রাগ কর না”। [সহিহ বুখারি]

৭) রাগ দমনের উপায়:

সালমান বিন সুরাদ রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট বসে ছিলাম। এমতাবস্থায় তার নিকট দু জন লোক পরস্পরকে গালাগালি করতে লাগল। দু জনের মধ্যে একজন লোক অপরজনকে এত বেশি রাগ করে গালি দিচ্ছিল যে, রাগে তার চেহারা লাল হয়ে গিয়েছিল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রা. বললেন, আমি এমন একটি কথা জানি সে যদি তা বলে তবে তার রাগ দূর হয়ে যাবে। সে কথাটি হল: “আঊযুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজীম।”

সাহাবিগণ লোকটিকে রা. বললেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি বলছে তা কি শুনতে পাও না? তখন রাগান্বিত লোকটি বলল: আমি পাগল নই। [বুখারি ও মুসলিম]

৮) রাগ দমনের আরও কতিপয় কৌশল:

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তোমাদের কেউ রাগ করলে সে যদি দাঁড়িয়ে থাকে তবে বসে পড়বে। এতেও যদি রাগ না যায় তবে শুয়ে পড়বে। (আবু দাউদ, সহিহ-সহীহুল জামে)।

৯) শত্রুকে বন্ধু বানানোর উপায়:

আল্লাহ তাআলা বলেন,

ادْفَعْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ فَإِذَا الَّذِي بَيْنَكَ وَبَيْنَهُ عَدَاوَةٌ كَأَنَّهُ وَلِيٌّ حَمِيمٌ

“সব চেয়ে সুন্দর পদ্ধতিতে তার উত্তর দাও দেখবে তোমার মাঝে এবং যার মাঝে শত্রুতা ছিল সে যেন তোমার অন্তরঙ্গ বন্ধুতে পরিণত হয়ে গেছে। [সূরা ফুসসিলাত/হা মীম সাজদাহ: ৩৪]

ইবনে আব্বাস রা. আল্লাহ তাআলার নিন্মোক্ত আয়াতটির ব্যাখ্যায় বলেন, সুন্দরতম পদ্ধতি হল,রাগ আসলে ধৈর্য ধারণ করা আর কেউ খারাপ ব্যাবহার করলে তাকে ক্ষমা করা। মানুষ যদি এ নীতি অবলম্বন করে তবে আল্লাহ তাদেরকে হেফাজত করবেন এবং দুশমন তাদের কাছে শুধু আনুগত্যই স্বীকার করবে না বরং অন্তরঙ্গ বন্ধুতে পরিণত হবে। [বুখারি-মুআল্লাক সনদে]

প্রেরণা-১০: ধৈর্য ধারণ

১) ধৈর্যের আদেশ আসমান থেকে

আল্লাহ তাআলা বলেন,

 وَاصْبِرْ وَمَا صَبْرُكَ إِلَّا بِاللَّـهِ ۚ وَلَا تَحْزَنْ عَلَيْهِمْ وَلَا تَكُ فِي ضَيْقٍ مِّمَّا يَمْكُرُونَإِنَّ اللَّـهَ مَعَ الَّذِينَ اتَّقَوا وَّالَّذِينَ هُم مُّحْسِنُونَ

“আপনি সবর করবেন। আপনার সবর তো কেবল আল্লাহর জন্য। তাদের জন্যে দুঃখ করবেন না এবং তাদের চক্রান্তের কারণে মন ছোট করবেন না। নিশ্চয় আল্লাহ তাদের সঙ্গে আছেন, যারা পরহেজগার এবং যারা সৎকর্ম করে।” [সূরা আন নাহল: ১২৭ ও ১২৮]

২) যে ধৈর্যের তুলনা হয় না

বুখারি ও মুসলিমে বর্ণিত, আয়েশা রা. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে জিজ্ঞেস করলেন: উহুদ যুদ্ধের চেয়ে কঠিন দিন কি আর কখনো আপনার জীবনে এসেছিল?

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রা. বললেন, তোমার জাতির কাছে এর থেকেও বেশি কষ্ট পেয়েছি। আর সব চেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছি আকাবার দিন। যে দিন আমি ইবনে আব্দে ইয়ালীল ইবনে কালালের কাছে নিজেকে পেশ করলাম। আমি যা চাই তাতে সে সাড়া দিল না। তাই আমি দুশ্চিন্তা গ্রস্ত অবস্থায় সেখান থেকে চলে এলাম। আর আর যখন আমার হুশ ফিরল তখন দেখি কারনুস্ সাআলিব (তায়েফ ও মক্কার মধ্যবর্তী একটি স্থানের নাম) এসে পৌঁছেছি। মাথা উপরে উঠিয়ে দেখি একখণ্ড মেঘ আমাকে ছায়া দিচ্ছে। দেখলাম মেঘের মধ্যে জিবরাঈল আ. উপস্থিত।

জিবরাঈল আ. (আমাকে ডাক দিয়ে) বলছেন, আপনার সম্প্রদায় আপনাকে যা বলেছে এবং যেভাবে আপনার আহবানের উত্তর দিয়েছে আল্লাহ তাআলা সব কিছুই শুনেছেন। তাই তিনি আপনার কাছে পাহাড়ের ফেরেশতাকে পাঠিয়েছেন। আপনি তাঁকে এদের ব্যাপারে যা ইচ্ছা নির্দেশ দিতে পারেন।

পাহাড়ের ফেরেশতা (রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সালাম দিয়ে) রা. বললেন, হে মুহাম্মদ, আপনার জাতি আপনাকে কী বলেছেন আল্লাহ তা অবশ্যই শুনেছেন। আমি পাহাড়ের ফেরেশতা। আল্লাহ তাআলা আমাকে আপনার নিকট পাঠিয়েছেন, ওদের ব্যাপারে আপনি আমাকে যে কোন আদেশ করতে পারেন। আপনি চাইলে (মক্কার) দুটি পাহাড় তাদের উপর চাপা দিয়ে তাদেরকে সমূলে ধ্বংস করে দিব।

রাসুল রা. বললেন, “না, বরং আমি আশা করি,তাদের ঔরস থেকে এমন মানুষ জন্ম নিবে যারা এক আল্লাহর ইবাদত করবে এবং তার সাথে কোন কিছুকে শরীক করবে না।” [বুখারি ও মুসলিম]

৩) মানুষের খারাপ মন্তব্য শুনে ধৈর্য ধারণ:

ইবনে মাসউদ হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যুদ্ধলদ্ধ সম্পদ বণ্টন করলেন। তখন এক ব্যক্তি বলে উঠল, “আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে এ বণ্টন করা হয় নি!!”

ইবনে মাসউদ লোকটির কথা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে শুনালে তাঁর চেহারার রং পরিবর্তন হয়ে গেল। রা. বললেন, “আল্লাহ তাআলা মূসা আলাইহিস সালাম এর উপর রহম করুন। তাঁকে এর থেকেও বেশি কষ্ট দেওয়া হয়েছে কিন্তু তিনি তাতে ধৈর্য ধারণ করেছেন।” [বুখারি ও মুসলিম]

৪) ওহুদের রক্তাক্ত প্রান্তরে ধৈর্য ধারণ:

 ওহুদ যুদ্ধে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাড়ির দাঁত ভেঙ্গে গেল। মাথা আহত হওয়ায় সেখান থেকে রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে। এ অবস্থায় তিনি বলছেন: সে জাতি কীভাবে সফলতা লাভ করবে যারা তাদের নবীর দাঁত ভেঙ্গে ফেলে এবং তাঁর মাথা রক্তাক্ত করে অথচ তিনি তাদেরকে এক আল্লাহর পথে আহবান করছেন?!

এদিকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উপর কুরআন অবতীর্ণ হয়ে গেল:

لَيْسَ لَكَ مِنَ الْأَمْرِ شَيْءٌ أَوْ يَتُوبَ عَلَيْهِمْ أَوْ يُعَذِّبَهُمْ فَإِنَّهُمْ ظَالِمُونَ

“এ ব্যাপারে তোমার কিছুই করার অধিকার নেই। হয় তারা তওবা করবে নতুবা আল্লাহ তাদেরকে শাস্তির সম্মুখীন করবেন। কারণ এরা অত্যাচারী।” [সূরা আলে ইমরান: ১২৮]

৫) জুলুম-নির্যাতনে ধৈর্যের চরম পরাকাষ্ঠা:

 খাব্বাব বিন আরাত রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাবা শরীফের ছায়ায় একটি চাদরকে বালিশ বানিয়ে তাতে হেলান দিয়ে বসে আছেন। আমরা তাঁর নিকট গিয়ে অভিযোগ করে বললাম: আপনি কি আমাদের জন্য আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করবেন না? আমাদের জন্য দুআ করবেন না?

তিনি বললেন, তোমাদের পূর্বের লোকদের অবস্থা ছিল, তাদের কাউকে ধরে এনে গর্ত খনন করে তাকে সেই গর্তে দাঁড় করে পুঁতে ফেলা হত। তারপর করাত দিয়ে তাকে দ্বিখণ্ডিত করা হত এবং লোহার চিরুনি দিয়ে হাড্ডি থেকে গোশত আলাদা করে ফেলা হত তবুও দ্বীন থেকে তাকে ফেরানো সম্ভব হত না।

আল্লাহর কসম, অবশ্যই আল্লাহ তাআলা এই দ্বীনকে পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠা করবেন। আর অবস্থা এমন হবে যে, কাফেলা-দল সানয়া থেকে হাযারামাউত (ইয়েমেনের দুটি শহর) পর্যন্ত গমন করবে কিন্তু আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ভয় পাবে না। এমনকি মানুষ তার বকরীর ব্যাপারে নেকড়ে বাঘকেও ভয় করবে না। কিন্তু তোমরা তাড়াহুড়া করছ। [সহিহ বুখারি]

প্রেরণা-১১: দয়া ও নম্রতা

১) পরম দয়ালু অভিভাবক তিনি

আল্লাহ তাআলা বলেন,

لَقَدْ جَاءَكُمْ رَسُولٌ مِّنْ أَنفُسِكُمْ عَزِيزٌ عَلَيْهِ مَا عَنِتُّمْ حَرِيصٌ عَلَيْكُم بِالْمُؤْمِنِينَ رَءُوفٌ رَّحِيمٌ

“তোমাদের কাছে এসেছে তোমাদের মধ্য থেকেই একজন রসূল। তোমাদের দুঃখ-কষ্ট তার পক্ষে দুঃসহ। তিনি তোমাদের মঙ্গলকামী, মুমিনদের প্রতি স্নেহশীল, দয়াময়।” [সূরা তাওবা: ১২৮]

২) মসজিদে নববীতে এক বেদুঈনের পেশাবের ঘটনা:

আনাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার আমরা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাথে (মদিনার) মসজিদে বসেছিলাম। ইত্যবসরে এক বেদুঈন এসে মসজিদের ভেতর পেশাব করতে লাগল।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাহাবিগণ (চিৎকার করে): এই…থাম! থাম!

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম: তোমরা থাম, তার পেশাব বন্ধ কর না।

সাহাবিগণ তাকে পেশাব শেষ করতে দিলেন।

এবার রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বেদুঈনকে কাছে ডাকলেন।

 অতঃপর রা. বললেন, “মসজিদের ভেতর এভাবে পেশাব-পায়খানা করা বা ময়লা-আবর্জনা ফেলা ঠিক নয়। মসজিদ হল আল্লাহ জিকির-আজকার, নামায ও কুরআন তিলাওয়াতের স্থান।”

আর সাহাবিদেরকে রা. বললেন, “তোমাদেরকে দুনিয়াতে পাঠানো হয়েছে সহজ করার জন্য; কঠিন করার জন্য নয়।”

বেদুঈন: হে আল্লাহ,আমাকে ও মুহাম্মদকে দয়া কর। আমাদের সাথে আর কাউকে দয়া কর না।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম: তুমি প্রশস্ত জিনিস কে সংকীর্ণ করে দিলে! [বুখারি ও মুসলিম]

৩) নামাযে কথা বলার ঘটনা:

মুয়াবিয়া বিন হাকাম সুলামী রা. হতে বর্ণিত,তিনি বলেন, আমরা একবার রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাথে নামায আদায় করছিলাম। হঠাৎ মুসল্লিদের মধ্য থেকে এক লোক হাঁচি দিল।

মুয়াবিয়া রা. (হাঁচির উত্তরে): “ইয়ারহামুকাল্লাহ” (আল্লাহ তোমার প্রতি রহম করুন)।

অন্যান্য মুসল্লিগণ আমার এ কাজের প্রতিবাদে সবাই আমার দিকে তাকাতে লাগল।

মুয়াবিয়া রা. (মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে): কী ব্যাপার? আপনারা আমার দিকে তাকাচ্ছেন কেন?

একথা শুনে মুসল্লিগণ তাদের রানের উপর হাত দিয়ে আঘাত করতে লাগল যাতে তিনি নামাযে কথা না বলেন।

যখন তিনি দেখলেন যে, সবাই তাকে চুপ হতে বলছে তখন তিনি চুপ হয়ে গেলেন।

যাহোক এভাবে নামায শেষ হল।

মুয়াবিয়া রা. (রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রশংসায়): আমার বাবা-মা তার জন্য উৎসর্গ হোক। আমি তাঁর আগে বা পরে কখনই কোন শিক্ষকে তাঁর চেয়ে উত্তম পদ্ধতিতে শিক্ষা দিতে দেখিনি। কারণ-আল্লাহর কসম করে বলছি-তিনি আমাকে ধমকালেন না, মারলেন না বা গালিও দিলেন না।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (নামায শেষে): “নামাযের মধ্যে মানুষের কোন কথা বলা ঠিক নয়। বরং নামাযে শুধু আল্লাহর গুণগান, আল্লাহর বড়ত্বের ঘোষণা আর কুরআন তেলাওয়াত করতে হয়।”

মুআবিয়া রা.: হে আল্লাহর রাসুল! আমি জাহেলি যুগের খুব কাছের লোক। আল্লাহ তাআলা আমাকে ইসলামে এনেছেন (অর্থাৎ আমি একজন নতুন মুসলিম)। আমাদের কিছু লোক গণকদের নিকট যাতায়াত করে।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম: তবে তুমি গণকদের কাছে যেও না।

মুআবিয়া: আমাদের কিছু লোক কুলক্ষণে বিশ্বাস করে।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম: এটা একটা কুচিন্তা যা মানুষের মনের মধ্যে জাগ্রত হয়। এ কুচিন্তা যেন তাদেরকে কাজে বাঁধা না দেয়। (অর্থাৎ এ ধরণের কুচিন্তা মনে আসলে তা যেন তাদেরকে কাজে বাঁধা না দেয়। কারণ তা ভালো-মন্দ কোন কাজেই প্রভাব ফেলতে পারে না)। [সহিহ মুসলিম]

৪) ধৈর্য ও সহনশীলতার জীবন্ত উদাহরণ

আয়েশা রা. হতে বর্ণিত,তিনি বলেন, কয়েকজন ইহুদী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট আগমন করল।

ইহুদীরা: আসসামু আলাইকা (তোমার মৃত্যু হোক)

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম: ও আলাইকুম (তোমাদেরও)।

আয়েশা: তোমাদের মৃত্যু হোক, তোমাদের উপর আল্লাহর অভিশাপ হোক, তোমাদের উপর আল্লাহর ক্রোধ নেমে আসুক।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম: আয়েশা, থাম, নম্র হও। কঠোর ও অশালীন আচরণ থেকে দূরে থাক।

আয়েশা: তারা কি বলল আপনি কি শুনেন নি?

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম: তুমি কি শুনো নি আমি কী বলেছি? আমি তাদের কথার উত্তর দিয়েছি। আমার কথা আল্লাহ কবুল করবেন কিন্তু আমার ব্যাপারে তারা যা বলেছে তা কবুল হবে না। [সহিহ বুখারি]

অন্য বর্ণনায় এসেছে, আয়েশা রা.কে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রা. বললেন, “অশালীন হয়ো না। আল্লাহ তাআলা অশালীনতাকে এবং যারা অশালীন আচরণ করে তাদেরকে ভালবাসেন না।” [সহিহ মুসলিম]

প্রেরণা-১২: দয়া ও নম্রতা বিষয়ে একগুচ্ছ মনি-মুক্তা

১) রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “আল্লাহ তাআলা দয়ালু, তিনি দয়াশীলতাকে ভালবাসেন। নম্র আচরণে আল্লাহ যা দেন কঠিন আচরণ বা অন্য কোন পন্থায় তা দেন না।” [সহিহ মুসলিম]

২) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আয়েশা রা.কে বলেন, “দয়া সুলভ আচরণ করবে। রূঢ় ও অশালীন আচরণ থেকে দূরে থাকবে। যে কোন জিনিসে ধীরস্থীরতা ও নম্রতা থাকলে তা সৌন্দর্য মণ্ডিত হয়। আর কোন জিনিসে ধীরস্থীরতা ও নম্রতা না থাকলে তার সৌন্দর্য হানী ঘটে।” [সহিহ মুসলিম]

৩) “হে আয়েশা নম্র হও। আল্লাহ তাআলা আহলে বায়ত তথা নবী পরিবারের কল্যাণ চেয়েছেন বিধায় তাদের মধ্যে নম্রতা দিয়েছেন।” (মুসনাদ আহমদ-সহিহ)

৪) “যার মধ্যে নম্রতা নেই সে সব কল্যাণ থেকে বঞ্চিত।” [সহিহ মুসলিম]

৫) “যার ভাগ্যে নম্রতা দেওয়া হয়েছে সে বিরাট কল্যাণের অধিকারী। আর যার ভাগ্যে নম্রতা দেওয়া হয় নি সে অনেক কল্যাণ থেকে বঞ্চিত।” (আহমদ, তিরমিযি। আরনাবুত হাদিসটিকে হাসান বলেছেন)

৬) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন কাজে সাহাবিদেরকে প্রেরণ করলে বলতেন, “তোমরা মানুষকে সু সংবাদ দাও। তাদেরকে দূরে সরিয়ে দিও না। সহজ ও নম্র আচরণ কর, কঠিন করিও না।” [বুখারি ও মুসলিম]

৭) তিনি বলেন, “আমি নামায শুরু করার পর ইচ্ছা থাকে নামায লম্বা করব কিন্তু যখন শিশুর কান্নার আওয়াজ কানে আসে তখন নামায তাড়াতাড়ি শেষ করি। কারণ আমি জানি শিশুর আওয়াজে তার মায়ের মানসিক কত কষ্ট হয়।” [বুখারি ও মুসলিম]

প্রেরণা-১৩: এক সাহসী মানুষের গল্প

১) আল্লাহ তাআলা বলেন,

فَقَاتِلْ فِي سَبِيلِ اللَّـهِ لَا تُكَلَّفُ إِلَّا نَفْسَكَ ۚ وَحَرِّضِ الْمُؤْمِنِينَ ۖ عَسَى اللَّـهُ أَن يَكُفَّ بَأْسَ الَّذِينَ كَفَرُوا ۚ وَاللَّـهُ أَشَدُّ بَأْسًا وَأَشَدُّ تَنكِيلًا

“আল্লাহর পথে যুদ্ধ করতে থাকুন। আপনি নিজের সত্তা ব্যতীত অন্য কোন বিষয়ের জিম্মাদার নন! আর আপনি মুসলিমদেরকে উৎসাহিত করতে থাকুন। শীঘ্রই আল্লাহ কাফেরদের শক্তি-সামর্থ্য খর্ব করে দেবেন। আর আল্লাহ শক্তি-সামর্থ্যের দিক দিয়ে অত্যন্ত কঠোর এবং কঠিন শাস্তি দাতা।” (সূরা নিসা: ৮৪)

২) এক রাতে মদিনায় অদ্ভুত আওয়াজ

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেমন ছিলেন সবচেয়ে সুন্দর তেমনি ছিলেন সবচেয়ে উদার আর সাহসী।

মদিনাবাসীগণ একরাতে হঠাৎ একটি আওয়াজ শুনে আতংকিত হয়ে গেল। লোকজন ছুটল আওয়াজের উৎস খোঁজার জন্য। কিন্তু দেখা গেল রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফিরে আসছেন। রাস্তায় লোকজনের সাথে দেখা হল। শব্দ শুনে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সবার আগে সেখানে পৌঁছে গিয়ে ছিলেন।

অন্য বর্ণনায় এসেছে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘটনার সূত্র খুঁজতে সেখানে গিয়ে ছিলেন। আবু তালহার ঘোড়ার জিন বিহীন নগ্ন পিঠে চড়ে গলায় তলোয়ার ঝুলিয়ে তিনি আওয়াজের উৎসের সন্ধানে ছুটে বেরিয়ে ছিলেন।

ফিরে এসে রা. বললেন, আপনারা আতংকিত হবেন না। ভয়ের কিছু নেই।

আর ঘোড়াটির ব্যাপারে রা. বললেন, “ঘোড়াটিকে পেলাম সাগরের মত ক্ষিপ্র।” অথচ এর আগে সেটা ধীরে চলত। [সহিহ বুখারি ও মুসলিম]

৩) হুনাইন যুদ্ধে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাহসিকতা:

এক ব্যক্তি সাহাবি বারা রা. এর নিকট এসে বলল: হে আবু উমারা, আপনারা কি হুনাইন যুদ্ধের দিন ময়দান ছেড়ে পালিয়ে ছিলেন? তিনি বললেন, আল্লাহর নবীর ব্যাপারে আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, তিনি পালাননি। কিন্তু কিছু তাড়াহুড়া পরায়ণ মানুষ যাদের কাছে কোন তেমন অস্ত্র-শস্ত্র ছিল না তারা সেই হাওয়াযেন গোত্রের দিকে চলে গিয়েছিলো। আর হাওয়াযেন গোত্রের লোকেরা ছিল তীরন্দাজ। সে সব তীরন্দাজ (মুসলিমদের উপর) একজোট হয়ে পঙ্গপালের মত অবারিত ধারায় তীর বর্ষণ শুরু করলে মুসলিমগণ বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়।

এই পরিস্থিতিতে লোকজন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দিকে ছুটে আসে। এ সময় তিনি তার খচ্চরের উপরে আরোহণ করে ছিলেন আর তার লাগাম ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন আবু সুফিয়ান বিন হারিস রা.।

অত:পর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিচে নেমে যুদ্ধে বিজয় লাভের জন্য মহান আল্লাহর নিকট সাহায্য চেয়ে দুয়া করলেন অত:পর বলতে লাগলেন,

أَنَا النَّبِيُّ لَا كَذِبْ ، أَنَا ابْنُ عَبْدِ الْمُطَّلِبْ

“আমি মিথ্যাবাদী নই; আমি আব্দুল মুত্তালিবের সন্তান (বংশধর)।” হে আল্লাহ, তোমার সাহায্য অবতীর্ণ করো। [সহিহ বুখারি ও মুসলিম]

৪) ভয়াবহ যুদ্ধের সময়ও পরম নির্ভরতার প্রতীক তিনি:

বারা রা. বলেন, যুদ্ধ প্রচণ্ড আকার ধারণ করলে আমরা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মাধ্যমে আত্মরক্ষা করতাম। আমাদের মধ্যে সাহসী যোদ্ধাও তাকে সামনে রেখে যুদ্ধ করতো।(অর্থাৎ প্রচণ্ড যুদ্ধের সময় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের সামনে থাকতেন আর আমরা তার পেছনে থেকে শত্রুদের মোকাবেলা করতাম।) [সহিহ মুসলিম]

৫) সকল বীরের সেরা বীর:

আলী রা. হতে বর্ণিত, বদর যুদ্ধের দিন দেখেছি, আমরা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মাধ্যমে আত্মরক্ষার চেষ্টা করছি আর তিনি দুশমনের সবচেয়ে কাছে অবস্থান করছেন। তিনি সেদিন যুদ্ধের ময়দানে সবচেয়ে বেশি বীরত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন। (শারহুস সুন্নাহ-সনদ হাসান)

৬) কোদাল হাতে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম:

জাবের রা. বলেন, (খন্দক যুদ্ধের সময়) আমরা (মদিনার চারপাশে) পরিখা খনন করছিলাম। ইত্যবসরে একটি কঠিন শক্ত পাথর বের হলে আমরা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট আগমন করলাম।

সাহাবিগণ (রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে উদ্দেশ্য করে) রা. বললেন, এই শক্ত পাথরটি বের হয়েছে।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রা. বললেন, আমি গর্তে নামছি।

একথা বলে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। তখন তিনি ক্ষুধার যাতনায় পেটে পাথর বেঁধে রেখেছিলেন। তিনি একটি কোদাল হাতে নিয়ে পাথরের উপর আঘাত হানলেন আর সাথে সাথে সেটা যেন মসৃণ ধুলায় পরিণত হয়ে গেল।

(মূল ঘটনা বুখারি ও মুসলিমে উল্লেখিত হয়েছে)

প্রেরণা-১৪: দয়া ও করুণার মূর্ত প্রতীক

১) আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا رَحْمَةً لِّلْعَالَمِينَ

“তোমাকে তো সমগ্র জগতের দয়া স্বরূপ প্রেরণ করেছি।” (সূরা আম্বিয়া: ১০৭)

২) রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “আমি প্রেরিত হয়েছি দয়া সহকারে।” [সহিহ মুসলিম]

৩) তিনি বলেন, আমি (বিশ্ব চরাচরের জন্য) দয়ার উপহার। (মুসতাদরাক হাকিম। ইমাম হাকিম হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন আর ইমাম যাহাবী তাতে সম্মতি দিয়েছেন)

৪) তিনি বলেন, “যে মানুষের প্রতি দয়া করে না আল্লাহ তার উপর দয়া করবেন না।” [বুখারি ও মুসলিম]

৫) “দয়া তো তার থেকেই উঠিয়ে নেওয়া হয় যে হতভাগ্য।” [তিরমিযি প্রমুখ। আরনাবুত হাদিসটিকে হাসান বলেছেন]

 ৬) দয়াময় আল্লাহ দয়ালু মানুষদের প্রতি দয়া করেন। তোমরা পৃথিবী বাসির উপর দয়া কর তবে যিনি আসমানে (আসমানের উপরে) আছেন তোমাদের প্রতি দয়া করবেন।” (তিনি হলেন আল্লাহ তাআলা)

[আহমদ প্রমুখ। শাইখ আলবানি ও আরবাবুত হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন]

৭) আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আলী রা. এর ছেলে হাসান রা.কে চুমু দিলেন। এ সময় তার পাশে ছিল আকরা বিন হাবেস। তিনি বললেন, আমার দশজন সন্তান আছে কিন্তু আমি তাদের কাউকে কোন দিন চুমু দেইনি। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার দিকে তাকিয়ে রা. বললেন, “যে দয়া করে না তার উপর দয়া করা হয় না।” [বুখারি ও মুসলিম]

৮) আয়েশা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক বেদুঈন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট এসে বলল, আপনারা শিশুদেরকে চুমু দেন কিন্তু আমরা দেই না। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রা. বললেন, “আল্লাহ তোমার অন্তর থেকে দয়া-মায়া উঠিয়ে নিলে তার দায়-দায়িত্ব কি আমার?” [বুখারি ও মুসলিম]

৯) রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন অত্যন্ত দয়ালু স্বভাবের। যে কেউ তার কাছে কোন দরকারে আসলে তাকে ওয়াদা দিতেন এবং তার নিকট সেটা থাকলে তা পূরণ করতেন। [ইমাম বুখারি রা. রচিত আল আদাবুল মুফরাদ। সনদ হাসান]

১০) আনাস রা. বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর থেকে পরিবারের প্রতি এত বেশি দয়া সুলভ আচরণ করতে আর কাউকে দেখিনি। [সহিহ মুসলিম]

প্রেরণা-১৫: পশু-পাখির প্রতি মমতা ও ভালবাসা

১) উটের প্রতি মমতা:

সুহাইল বিন হানযালা রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি উটের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। দেখলেন, উটটির পিঠ পেটের সাথে লেগে গেছে। তিনি বললেন, তোমরা এ নির্বাক প্রাণীগুলোর ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর। তোমরা এ পশুগুলোতে সুস্থ-সবল অবস্থায় আরোহণ কর এবং সুস্থ-সবল অবস্থায় জবেহ করে খাও। [আবু দাউদ-সনদ হাসান]

২) চড়ুই পাখি ও পিপীলিকার প্রতি মমতা:

আব্দুল্লাহ তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আমরা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাথে কোন এক সফরে ছিলাম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর দরকারে কোথাও গেলেন। আমরা চুড়ই জাতীয় একটি পাখি দেখতে পেলাম। পাখীটির সাথে আছে তার দুটি বাচ্চা। আমরা বাচ্চা দুটিকে ধরে নিয়ে এলাম। দেখা গেল মা পাখিটি আমাদের কাছে এসে অস্থির হয়ে ডানা ঝাপটানো শুরু করল।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর কাজ থেকে ফিরে এসে এ অবস্থা দেখে রা. বললেন, বাচ্চাগুলো ধরে এনে কে এ পাখিটিকে কষ্ট দিচ্ছে? যাও, বাচ্চাগুলোকে ওর নিকট ফিরিয়ে দাও।

তিনি আরও দেখতে পেলেন, আমরা একটি পিঁপড়ার বাসা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছি।

 রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম: কে এটা পুড়ালো?

বললাম: আমরা।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আগুনের যিনি প্রভু (আল্লাহ তাআলা) তিনি ছাড়া অন্য কারও জন্য আগুন দ্বারা শাস্তি দেওয়া উচিৎ নয়। (আহমদ প্রমুখ। এই হাদিসটির সনদকে সহিহ বলেছেন, শুয়াইব আরনাবুত)

৩) বিড়ালের প্রতি ভালবাসা:

 তিনি বিড়ালকে পানি পান করানোর জন্য ওযুর পাত্র কাত করে দিতেন। আর বিড়াল সেখান থেকে তৃপ্তি সহকারে পান করত। অতঃপর অবশিষ্ট পানি দ্বারা তিনি ওযু করতেন। (ত্ববারানী-সহিহ)

৪) ছাগলের প্রতি দয়া:

ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোথাও যাওয়ার সময় দেখলেন, এক ব্যক্তি ছাগলের পিঠে পা রেখে চেপে ধরে ছুরি ধার দিচ্ছে। আর ছাগলটি তার দিকে তাকাচ্ছে।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রা. বললেন, তুমি কি এটাকে দু বার মারতে চাও? এটাকে শুয়ানোর আগে ছুরিটি ধার দাও নি কেন?

[মুস্তাদরাক হাকিম। ইমাম হাকিম বলেন, হাদিসটি শাইখাইন তথা ইমাম বুখারি ও মুসলিমের শর্তানুযায়ী সহিহ। ইমাম যাহাবী এ কথায় সম্মতি দিয়েছেন]।

৫) পশু জবেহের ক্ষেত্রে নির্দেশনা:

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আল্লাহ তাআলা সব কিছুর প্রতি দয়াসূলভ আচরণ করা আবশ্যক করেছেন। সুতরাং তোমরা হত্যা করলে দয়া সহকারে হত্যা কর। পশু জবেহ করলে সুন্দরভাবে জবেহ কর। আর ছুরিটিকে ভালো করে ধার দিয়ে নাও যাতে পশুটির বেশি কষ্ট না হয়। [সহিহ মুসলিম]

৬) যারা পশুদের উপর জুলুম করে তাদের পরিণতি:

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “জনৈক মহিলা একটি বিড়ালকে আটকে রেখে মেরে ফেলায় আজাবের সম্মুখীন হয়েছে। একারণেই তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করানো হয়েছে। সে বিড়ালটিকে বন্দি করে রেখেছিল কিন্তু তাকে খাবার-পানি খেতে দেয় নি আবার ছেড়েও দেয়নি যাতে সে নিজে মাটি থেকে পোকা-মাকড় ধরে খেতে পারে।” [সহিহ বুখারি]

প্রেরণা-১৬ : ন্যায়-ইনসাফের সার্বজনীন ষোষণা

১) এ নির্দেশ এসেছে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে

আল্লাহ তাআলা বলেন,

إِنَّ اللَّـهَ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ وَالْإِحْسَانِ

“আল্লাহ ন্যায় ও ইহসান (দয়া সুলভ আচরণ) এর নির্দেশ দেন।” [সূরা নাহল: ৯০]

২) ঐশী নির্দেশ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি

তিনি আরও বলেন,

وَأُمِرْتُ لِأَعْدِلَ بَيْنَكُمُ

“আর আমাকে (রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে) আদেশ করা হয়েছে তোমাদের মাঝে ন্যায়-পরায়নতা প্রতিষ্ঠা করতে।” (সূরা শুরা: ১৫)

৩) পৃথিবী দেখে নাও, ন্যায়-পরায়নতা কাকে বলে?

আয়েশা রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, মাখযুম কবিলার এক মেয়ে চুরি করে ধরা পড়ায় তার বিষয়টি কুরাইশদের নিকট বিরাট ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল।

তারা আলোচনা করল, কে ব্যাপারটি নিয়ে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাথে কথা বলবে?

সবাই বলল: রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর একান্ত প্রিয় ব্যক্তি উসামা বিন যায়েদ ছাড়া তার সাথে এ ব্যাপারে কথা বলার সাহস আর কারও নাই।

যাহোক, উসামা ব্যাপারটি নিয়ে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাথে কথা বললেন।

তার কথা শুনে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রা. বললেন, তুমি আল্লাহর নির্ধারিত দণ্ডবিধির ব্যাপারে সুপারিশ করতে এসেছ!

এরপর তিনি দাঁড়িয়ে জনগণের সামনে একটি ভাষণ দিলেন। ভাষণে রা. বললেন,

“তোমাদের পূর্বের জাতিগুলো ধ্বংস হয়েছে। কারণ তাদের নীতি ছিল, কোন সম্ভ্রান্ত লোক চুরি করলে তারা তাকে ছেড়ে দিত। আর কোন দুর্বল লোক চুরি করলে তার উপর দণ্ডবিধি প্রয়োগ করত। আল্লাহর কসম করে বলছি, মুহাম্মদের মেয়ে ফাতিমাও যদি চুরি করত তবে আমি অবশ্যই তার হাত কাটতাম।”

এরপর যে মেয়েটি চুরি করেছিল তার হাত কাটার নির্দেশ দিলেন এবং নির্দেশ মোতাবেক হাত কাটা হল।

আয়েশা রা. বলেন, মেয়েটি পরে খুব ভালোভাবে তওবা করেছিল। তার বিয়ে হয়েছিল। পরবর্তীতে সে কোন প্রয়োজনে আসলে আমি তার প্রয়োজনের কথা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট পেশ করতাম। [বুখারি ও মুসলিম]

৫) রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হুনাইন যুদ্ধ থেকে ফিরে আসার সময় একদল বেদুঈন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট চাইতে চাইতে তাঁর পেছনে পেছনে আসতে শুরু করল। অবশেষে তাঁকে একটি গাছের নিকট আশ্রয় নিতে বাধ্য করল। এমনকি তাঁর গা থেকে চাদরও ছিনিয়ে নেওয়া হল। তখন তিনি তাঁর আরোহীর উপরেই অবস্থান করছিলেন।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রা. বললেন, আমার চাদর ফেরত দাও। তোমরা কি আশংকা করছ যে, আমি তোমাদের সাথে কৃপণতা করব? আল্লাহর কসম, আমার নিকট যদি এসব কাঁটাযুক্ত গাছ পরিমাণও উট থাকত তবে সবই তোমাদের মাঝে বণ্টন করে দিতাম এবং আমাকে কৃপণ, ভীরু বা মিথ্যেবাদী হিসেবে পেতে না।” [সহিহ বুখারি]

৬) জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি এক যুদ্ধে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাথে ছিলাম। আমার উটটি ক্লান্তিতে দুর্বল হয়ে যাওয়ায় ধীরে ধীরে পথ চলতে লাগল।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (আমার কাছে এসে): জাবের!

আমি: জি।

রাসুল: কী ব্যাপার তোমার?

আমি: আমার উটটি ক্লান্তিতে দুর্বল হয়ে পড়ায় খুব ধীরে হাঁটছে। তাই আমি পিছে পড়ে গেছি।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার সওয়ারী থেকে নেমে তার হাতে থাকা ছড়ি (যেটির মাথার অগ্রভাগ বাঁকানো ছিল। যেন নিচে কোন কিছু পড়ে গেলে সেটি দ্বারা উঠিয়ে নেওয়া যায়) দিয়ে উটটির শরীরে গুঁতো দিলেন। তারপর বললেন, এবার উঠো।

আমি উটের পিঠে উঠে বসলাম। তারপর দেখলাম, আমার উটটি এতটাই দ্রুত গতি সম্পন্ন হয়ে গেলো যে, সেটি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে বাধা দিচ্ছে যাতে তাকে অতিক্রম করতে না পারে।

অত:পর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রা. বললেন, তুমি তোমার উটটি বিক্রি করবে?

বললাম: হ্যাঁ। এরপর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেটি এক উকিয়া স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে ক্রয় করে নিলেন।

এরপর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে জিজ্ঞেস করলেন: বিয়ে করেছ?

আমি: হ্যাঁ।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম: কুমারী না বিবাহিত?

আমি: বিবাহিত।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম: কুমারী মেয়ে বিয়ে করলে তো তোমরা পরস্পরে খেলাধুলা করতে পারতে?

আমি: আমার কয়েকটি বোন আছে। তাই আমি এমন একজন মহিলাকে বিয়ে করা ভালো মনে করলাম যে, তাদেরকে একসাথে রাখবে, তাদের মাথার চুল আঁচড়িয়ে দিবে এবং তাদের সবাইকে দেখা-শুনা করবে।

যাহোক, তিনি আমার আগেই মদিনা এসে পৌঁছেছেন। আমি পৌঁছলাম পরের দিন। আমরা মসজিদে এসে দেখি তিনি মসজিদের দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম: এখন এলে?

আমি: জি, হ্যাঁ।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম: উট রেখে মসজিদের এসে দু রাকাত নামায পড়।

আমি মসজিদে প্রবেশ করে নামায পড়লাম।

অত:পর তিনি বেলাল রা. কে এক উকিয়া পরিমাণ স্বর্ণমুদ্রা মেপে আমাকে দেওয়ার জন্য বললেন। বেলাল রা. তা মেপে দিলেন তবে পাল্লা ভারী করে কিছু বেশি দিলেন।

আমি (উট রেখে) চলে যাচ্ছিলাম। ইত্যবসরে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রা. বললেন, জাবেরকে আমার নিকট ডাক। (মনে মনে) বললাম, এখন হয়ত রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার উট ফেরত দিবেন। ফিরিয়ে দিলে আমার নিকট এর থেকে খারাপ অন্য কিছু লাগবে না।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম: “তোমার উট নাও। সাথে উটের মূল্যও নাও।” [সহিহ বুখারি]

প্রেরণা-১৭: রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর লজ্জাশীলতা

১) আল্লাহ তাআলা বলেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَدْخُلُوا بُيُوتَ النَّبِيِّ إِلَّا أَن يُؤْذَنَ لَكُمْ إِلَىٰ طَعَامٍ غَيْرَ نَاظِرِينَ إِنَاهُ وَلَـٰكِنْ إِذَا دُعِيتُمْ فَادْخُلُوا فَإِذَا طَعِمْتُمْ فَانتَشِرُوا وَلَا مُسْتَأْنِسِينَ لِحَدِيثٍ ۚ إِنَّ ذَٰلِكُمْ كَانَ يُؤْذِي النَّبِيَّ فَيَسْتَحْيِي مِنكُمْ ۖ وَاللَّـهُ لَا يَسْتَحْيِي مِنَ الْحَقِّ

“হে ইমানদারগণ, তোমাদেরকে অনুমতি না দেওয়া হলে আহার্য রান্নার অপেক্ষা না করে নবীর ঘরে প্রবেশ করনা। তবে ডাকা হলে প্রবেশ কর। আর খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে চলে যাও। নিজেদের পক্ষ থেকে আলাপচারিতা শুরু করনা। নিশ্চয় এটা তার জন্য কষ্টদায়ক। তিনি তোমাদের থেকে লজ্জাবোধ করেন। কিন্তু আল্লাহ সত্য কথা বলতে লজ্জাবোধ করেন না।” (সূরা আহযাব: ৫৩)

২) “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পর্দার অন্তরালের কুমারী মেয়ের থেকেও বেশি লজ্জাশীল ছিলেন। তিনি কোন কিছু অপছন্দ করলে আমরা তার চেহারা দেখে বুঝতে পারতাম।“ [বুখারি ও মুসলিম]

৩) রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “লজ্জা ঈমানের অংশ। লজ্জা পুরোটাই কল্যাণকর।” [সহিহ মুসলিম]

৪) তিনি আরও বলেন, “লজ্জা ঈমানের অংশ। আর ঈমান থাকবে জান্নাতে। আর বেহায়াপনা আসে রুক্ষতা থেকে। আর রুক্ষতা থাকবে জাহান্নামে।” (তিরমিযি প্রমুখ। সহিহ-আলবানি)

৫) “লজ্জা আর ঈমানকে একসাথে যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে একটি চলে গেলে অপরটিও বিদূরিত হবে।” (হাকেম ও বাইহাকী। সহিহ আলবানি)

৬) “লজ্জা কেবল বয়ে আনে কল্যাণ।” [সহিহ বুখারি ও মুসলিম]

৭) “লজ্জাবোধ ও কম কথা বলা ঈমানের দুটি শাখা এবং লজ্জাহীনতা ও কথা-বার্তায় কৃত্রিমতা প্রকাশ করা মুনফেকীর দুটি শাখা। (মুসনাদ আহমদ প্রমুখ। ইমাম যাহাবী ও আলবানি হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন।)

৮) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক ব্যক্তিকে খোলা জায়গায় গোসল করতে দেখে (এ বিষয়ে মানুষকে দিকনির্দেশনা দেওয়ার জন্য) মিম্বারে উঠলেন। অতঃপর আল্লাহর প্রশংসা ও স্তুতি জ্ঞাপন করার পর রা. বললেন, আল্লাহ নিজেকে পর্দার অন্তরালে রাখেন। তিনি লজ্জা ও পর্দাশীলতাকে পছন্দ করেন। অতএব,তোমাদের কেউ গোসল করলে সে যেন পর্দা সহকারে করে। (মুসনাদ আহমদ প্রমুখ। আলবানি হাদিসটিকে মিশকাত কিতাবে সহিহ বলেছেন)।

৯) “প্রতিটি ধর্মের কিছু নৈতিকতা আছে। আর ইসলামের নৈতিকতা হল লজ্জাশীলতা।” (ইবনে মাজাহ। সনদ হাসান)।

১০) “নবুওয়তের প্রথম পর্যায়ের যে সব কথা মানুষ লাভ করেছে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হল, লজ্জা না থাকলে যা ইচ্ছা তাই কর।” [সহিহ বুখারি]

১১) “ঈমানের ষাটটি (অন্য বর্ণনানুযায়ী) সত্তরটির বেশি শাখা রয়েছে। তন্মধ্যে সর্বোচ্চ হল, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলা তথা একথার স্বীকৃতি দেওয়া যে, আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন উপাস্য নাই। আর সর্বনিম্ন হল, রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে ফেলা। আর লজ্জা হল ঈমানের অন্যতম একটি শাখা।” [সহিহ মুসলিম]

১২) সালেম তার পিতা আব্দুল্লাহ থেকে বর্ণনা করে বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোথাও যাওয়ার সময় দেখলেন, এক লোক তার ভাইকে লজ্জা করার ব্যাপারে তিরস্কার করছে। (অর্থাৎ তার ভাই লজ্জা করার কারণে তার ক্ষতি হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে সে তার ভাইকে বকাবকরি করছে)। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রা. বললেন, “ওকে ছাড়ো। কারণ লজ্জা তো ঈমানের শাখা।” [বুখারি ও মুসলিম]

১৩) আনাস রা. হতে বর্ণিত। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “কোন জিনিসে বেহায়াপনা যুক্ত হলে সেটা হয় নিকৃষ্ট। আর কোন জিনিসে লজ্জা যুক্ত হলে তা হয় সৌন্দর্য মণ্ডিত।” [তিরমিযি প্রমুখ। সনদ সহিহ]

প্রেরণা-১৮: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ভদ্রতা ও শিষ্টাচার

১) রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কারও বাড়িতে গেলে সরাসরি দরজার সামনে দাঁড়াতেন না। বরং ডান বা বাম পাশে দাঁড়িয়ে বলতেন: “আসসালামু আলাইকুম, আসলামু আলাইকুম।” (আহমদ-সহিহ)

২) তিনি উপহার গ্রহণ করতেন আর তার প্রতিদান দিতেন। [সহিহ বুখারি]

৩) তিন খারাপ অর্থবোধক নাম পরিবর্তন করে দিতেন। [সহিহ বুখারি]

৪) মানুষ রোগাক্রান্ত হলে তিনি পরিচর্যা করতে যেতেন এবং তার নিকট গিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে বলতেন: “লা বা’স, ত্বহুর ইনশাআল্লাহ।”

অর্থ: অসুবিধা নেই, ইনশাআল্লাহ সুস্থ হয়ে যাবে। [সহিহ বুখারি]

৫) পানি পান করার ক্ষেত্রে তাঁর নিয়ম ছিল, তিন নিঃশ্বাসে পান করতেন। (পাত্রের বাইরে নিশ্বাস ফেলতেন) আর পান শেষে বলতেন: এভাবে পান করা বেশি আরামদায়ক, সহজ ও রোগের আরোগ্য।

৬) তিনি যখন কাফেলার সাথে চলতেন তখন সাহাবিগণ তার আগে চলত আর তিনি চলতেন সবার পেছনে। [ইবনে মাজাহ-সহিহ]

৭) তিনি বাইআত বা আনুগত্যের শপথে পর মহিলাদের সাথে হাত মিলতেন না। [মুসনাদ আহমদ-হাসান]

৮) তিনি খাওয়া, পান করা, ওযু করা, কাপড় পরা, দেওয়া-নেওয়া ইত্যাদি ক্ষেত্রে ডান হাত ব্যবহার করতেন। আর অন্যান্য কাজে বাম হাত ব্যবহার করতেন। (আহমদ-সহিহ)

৯) তিনি যদি জানতে পারতেন যে, তার পরিবারের কেউ মিথ্যা বলেছে তবে তিনি তাকে এড়িয়ে চলতেন যতক্ষণ না সে তওবা করে। (আহমদ-সহিহ)

১০) আয়েশা রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক ব্যক্তি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিকট আসার অনুমতি চাইলে তিনি বললেন, তাকে আসার অনুমতি দাও। কারণ সে একটা খারাপ লোক। কিন্তু সে ভিতরে আসলে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার সাথে নম্র ভাবে কথা বললেন।

(সে চলে গেলে) আমি: হে আল্লাহর রাসুল, লোকটির ব্যাপারে আপনি যা বলার বললেন কিন্তু সে আপনার নিকট প্রবেশ করলে তার সাথে নম্র ভাবে কথা বললেন!!

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম: আল্লাহর নিকট সবচেয়ে নিকৃষ্ট সে ব্যক্তি যার মুখের অশালীন ভাষা থেকে বাঁচার জন্যে মানুষ তাকে পরিত্যাগ করেছে।(সহীহুল বুখারি, কিতাবুল আদব)

প্রেরণা-১৯: রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দানশীলতা

১) রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সকল মানুষের চেয়ে বেশি দানশীল ছিলেন। তবে সব চেয়ে বেশি দান করতেন রমাযান মাসে। মাস শেষ হওয়া পর্যন্ত এরূপ চলতে থাকত। সে সময় জিবরাঈল আলাইহিস সালাম এসে তার নিকট কুরআন পেশ করতেন আর জিবরাঈলের সাক্ষাত কালীন সময় তিনি প্রবাহিত বাতাসের চেয়েও বেশি দান করতেন। [সহিহ বুখারি]

২) আনাস রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইসলাম গ্রহণের শর্তে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট কিছু চাওয়া হলে তিনি দিতেন।

 আনাস রা. বলেন, এমন এক ব্যক্তি তার নিকট আসলে তিনি তাকে দু পাহাড়ের মধ্যবর্তী জায়গা ভর্তি ছাগলের পাল দান করলেন। [সহিহ মুসলিম]

৩) আনাস রা. হতে বর্ণিত। এক লোক দুই পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে পথ চলার সময় একটি ছাগল চাইলে তিনি তাকে তা দিলেন। তখন সে লোকটি তার গোত্রের নিকট গিয়ে বলল: তোমরা ইসলাম গ্রহণ কর। কারণ আল্লাহর কসম করে বলছি, মুহাম্মদ এত দান করেন যে, তাতে আর দরিদ্রতার ভয় থাকবে না।

আনাস রা. বলেন, “কিছু মানুষ দুনিয়া পাওয়ার উদ্দেশ্যে ইসলাম গ্রহণ করে কিন্তু পরে ইসলাম তার কাছে দুনিয়া এবং দুনিয়ার সকল ধন-সম্পদ থেকে অধিক প্রিয় হয়ে যায়।” [সহিহ মুসলিম]

৪) শিহাব থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গাজওয়ায়ে ফাতহ তথা মক্কা বিজয় করলেন। অতঃপর তাঁর সঙ্গী মুসলিমদেরকে সাথে করে হুনাইন যুদ্ধ করলেন। এ যুদ্ধে আল্লাহ তাআলা তার দ্বীন ও মুসলিমদেরকে বিজয়ী করলেন। সে দিন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাফওয়ান বিন উমাইয়াকে ১০০টি উট দিলেন। পরে আরও ১০০টি। তারপরে আরও ১০০টি।

ইবনে শিহাব বলেন, সাঈদ বিন মুসাইয়িব আমার নিকট হাদিস বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, সাফওয়ান বলল: রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে যা দেওয়ার তা তো দিলেন। কিন্তু তখনও তিনি আমার কাছে সবচেয়ে ঘৃণিত মানুষ। অতঃপর তিনি আমাকে দিতেই থাকলেন। এক পর্যায়ে তিনি আমার নিকট দুনিয়ার সবচেয়ে প্রিয় মানুষে পরিণত হলেন। [সহিহ মুসলিম]

৫) রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হুনাইন যুদ্ধ থেকে ফিরে আসার সময় একদল বেদুঈন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট চাইতে চাইতে তাঁর পেছনে পেছনে আসতে শুরু করল। অবশেষে তাঁকে একটি গাছের নিকট আশ্রয় নিতে বাধ্য করল। এমনকি তাঁর গা থেকে চাদরও ছিনিয়ে নেওয়া হল। তখন তিনি তাঁর আরোহীর উপরেই অবস্থান করছিলেন।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রা. বললেন, আমার চাদর ফেরত দাও। তোমরা কি আশংকা করছ যে, আমি তোমাদের সাথে কৃপণতা করব? আল্লাহর কসম, আমার নিকট যদি এসব কাঁটাযুক্ত গাছ পরিমাণও উট থাকত তবে সবই তোমাদের মাঝে বণ্টন করে দিতাম এবং আমাকে কৃপণ, ভীরু বা মিথ্যেবাদী হিসেবে পেতে না।” [সহিহ বুখারি]

৬) জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি এক যুদ্ধে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাথে ছিলাম। আমার উটটি ক্লান্তিতে দুর্বল হয়ে যাওয়ায় ধীরে ধীরে পথ চলতে লাগল।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (আমার কাছে এসে): জাবের!

আমি: জি।

রাসুল: কি ব্যাপার তোমার?

আমি: আমার উটটি ক্লান্তিতে দুর্বল হয়ে পড়ায় খুব ধীরে হাঁটছে। তাই আমি পিছে পড়ে গেছি।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার সওয়ারী থেকে নেমে তার হাতে থাকা ছড়ি দিয়ে উটটির শরীরে গুঁতো দিলেন।

তারপর বললেন, এবার উঠো।

আমি উটের পিঠে উঠে বসলাম। তারপর দেখলাম, আমার উটটি এতটাই দ্রুত গতি সম্পন্ন হয়ে গেলো যে, সেটি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে বাধা দিচ্ছে যাতে তাকে অতিক্রম করতে না পারে।

অত:পর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রা. বললেন, তুমি তোমার উটটি বিক্রি করবে?

বললাম: হ্যাঁ। এরপর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেটি এক উকিয়া স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে ক্রয় করে নিলেন।

এরপর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে জিজ্ঞেস করলেন: বিয়ে করেছ?

আমি: হ্যাঁ।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম: কুমারী না বিবাহিত?

আমি: বিবাহিত।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম: কুমারী মেয়ে বিয়ে করলে তো তোমরা পরস্পরে খেলাধুলা করতে পারতে?

আমি: আমার কয়েকটি বোন আছে। তাই আমি এমন একজন মহিলাকে বিয়ে করা ভালো মনে করলাম যে, তাদেরকে একসাথে রাখবে, তাদের মাথার চুল আঁচড়িয়ে দিবে এবং তাদের সবাইকে দেখা-শুনা করবে।

যাহোক, তিনি আমার আগেই মদিনা এসে পৌঁছেছেন। আমি পৌঁছলাম পরের দিন। আমরা মসজিদে এসে দেখি তিনি মসজিদের দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম: এখন এলে?

আমি: জি, হ্যাঁ।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম: উট রেখে মসজিদের এসে দু রাকাত নামায পড়।

আমি মসজিদে প্রবেশ করে নামায পড়লাম।

অত:পর তিনি বেলাল রা. কে এক উকিয়া পরিমাণ স্বর্ণমুদ্রা মেপে আমাকে দেওয়ার জন্য বললেন। বেলাল রা. তা মেপে দিলেন তবে পাল্লা ভারী করে কিছু বেশি দিলেন।

আমি (উট রেখে) চলে যাচ্ছিলাম। ইত্যবসরে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রা. বললেন, জাবেরকে আমার নিকট ডাক। (মনে মনে) বললাম, এখন হয়ত রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার উট ফেরত দিবেন। ফিরিয়ে দিলে আমার নিকট এর থেকে খারাপ অন্য কিছু লাগবে না।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম: “তোমার উট নাও। সাথে উটের মূল্যও নাও।” [সহিহ বুখারি]

প্রেরণা-২০: রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কৌতুক

১) কৌতুকের ছলেও তিনি অসত্য বলতেন না:

আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত। তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, আপনি আমাদের সাথে রসিকতা করেন! তিনি বললেন, “আল্লাহর কসম আমি সত্য ছাড়া অন্য কিছু বলি না।” (অর্থাৎ হাসির ছলেও আমি কখনই মিথ্যা কথা বলি না)।

২) ছোট্ট শিশু আবু উমাইর সাথে কৌতুক:

আনাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন সবচেয়ে সুন্দর চরিত্রের অধিকারী। আমার ছোট একটি ভাই ছিল যার নাম আবু উমাইর। সে তখনো দুধ পান করত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখনই আমাদের বাড়িতে আসতেন তখনই তাকে লক্ষ্য করে বলতেন, “হে আবু উমাইর, কি করল তোমার নুগাইর?” কারণ তার একটি পাখি ছিল যার নাম, নুগার। সে এটা নিয়ে খেলাধুলা করত। তাই তাকে আনন্দ দেওয়ার জন্য তিনি পাখিটির কথা তাকে বলতেন। [বুখারি ও মুসলিম] (পাখিটি দেখতে অনেকটা চড়ুই পাখির মত)।

৩) উটনির বাচ্চা:

আনাস রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক ব্যক্তি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট একটা বাহনের জন্য আবেদন করলে তিনি তাকে রা. বললেন, আমি তোমাকে একটি উটনীর বাচ্চা দিব। লোকটি বলল: উটনীর বাচ্চা দিয়ে আমি কী করব?

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রা. বললেন, কোন উট কি উটনী ছাড়া জন্মে? (অর্থাৎ প্রতিটি উটই তো কোন না কোন উটনীর বাচ্চা)। [আবু দাউদ ও তিরমিযি। সনদ সহিহ]

৪) দুই কানওয়ালা:

আনাস রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে “হে দুই কানওয়ালা” বলে ডেকেছিলেন।

৫) এক গ্রাম্য লোকের সাথে কৌতুক:

 আনাস রা. হতে বর্ণিত। এক গ্রাম্য লোক। যার নাম ছিল যাহের বিন হারাম। তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে পল্লী গাঁয়ের জিনিস উপহার দিতেন আর গ্রামে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা করলে বিনিময় হিসেবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও তাকে শহরের বিভিন্ন পণ্য-সামগ্রী প্রস্তুত করে দিতেন। তাই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রা. বললেন,

إِنَّ زَاهِرًا بَادِيَتُنَا وَنَحْنُ حَاضِرُوهُ

“যাহের হল আমাদের পল্লী-গ্রাম আর আমরা হলাম তার শহর।” (অর্থাৎ আমরা তার মাধ্যমে পল্লী-গাঁয়ের জিনিসপাতি দ্বারা উপকৃত হচ্ছি আর সে আমাদের মাধ্যমে শহরের জিনিসপাতি দ্বারা উপকৃত হচ্ছে।)

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে খুব ভালবাসতেন। তিনি ছিলেন দেখতে কুশ্রী। একদিন তিনি তার মালামাল বিক্রি করছিলেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পেছন থেকে এসে তাকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরলেন যাতে তিনি তাঁকে দেখতে না পান।

যাহের রা.: এই, কে কে? ছাড় আমাকে।

যাহের রা. পেছনে তাকিয়ে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে দেখে চিনতে পেরে তার পিঠ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বুকের সাথে লাগিয়ে দিলেন।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লোকজনকে লক্ষ্য করে বলতে লাগলেন: কে এই গোলামটি কিনবে?

যাহের বিন হারাম রা.: আল্লাহর কসম, তাহলে তো আমার দাম খুব কম পাবেন। (আপনার লোকসান হয়ে যাবে)।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম: “কিন্তু তুমি আল্লাহর নিকট কম মূল্যের নও।” অথবা বললেন যে, “তুমি আল্লাহর নিকট মূল্যবান।” [আহমদ,তিরমিযি। হাফেয ইবনে হাজার আল ইসাবা গ্রন্থে হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন]

প্রেরণা-২১: রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ঘুম

১) কখন ঘুমাতেন?

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাতের প্রথমভাগে ঘুমাতেন আর শেষরাতে জেগে ইবাদত-বন্দেগী করতেন।

২) ঘুমের দুয়া:

তিনি ঘুমানোর জন্য বিছানায় গেলে এ দুআটি পড়তেন:

 بِاسْمِكَ اللَّهُمَّ أَمُوتُ وَأَحْيَا

“বিসমিকা আল্লাহুম্মা, আমতু ওয়া আহইয়া।”

অর্থ: হে আল্লাহ তোমার নামেই মৃত্যু বরণ করি এবং তোমার নামেই জীবিত হই।

৩) ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়ার দুয়া:

আর ঘুম থেকে জেগে এই দুআটি পড়তেন:

 الحَمْدُ لله الذِي أحْيَانا بَعْدَ مَا أمَاتَنَا وإلَيْهِ النَشُور

“সমস্ত প্রশংসা ঐ আল্লাহর জন্য যিনি আমাদেরকে মৃত্যুর পর পুনরায় জীবিত করেছেন। আবার তার নিকটই ফিরে যেতে হবে।” [সহিহ মুসলিম]

৪) কিভাবে ঘুমাতেন?

তিনি বিছানায় শুয়ে পড়লে ডান হাতের তালুর উপর ডান গাল রেখে বলতেন:

رَبِّ قنِى عَذَابَكَ يَوْمَ تُبْعِثُ عِبَادَكَ

“হে প্রভু, যেদিন তুমি তোমার বান্দাদেরকে পুনর্জীবিত করবে আমাকে তুমি সে দিনের শাস্তি থেকে রক্ষা কর।” [তিরমিযি-হাসান সহিহ]

৪) ঘুমানোর আগের বিশেষ আমল:

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আরেকটি নিয়ম ছিল, তিনি বিছায় শুয়ে গেলে দু হাত একত্রিত করে তাতে সূরা ইখলাস, সূরা ফালাক এবং সূরা নাস পড়ে ফুঁ দিয়ে শরীরের যতদূর সম্ভব হাত বুলাতেন। আগে মাথা তারপর মুখ মণ্ডল অতঃপর শরীরের উপরিভাগে হাত বুলাতেন। এরূপ তিনি তিনবার করতেন। [বুখারি ও মুসলিম]

৫) বিছানা:

 “যে বিছানায় তিনি ঘুমাতেন সেটা ছিল চামড়ার তৈরি। ভিতরের জিনিস ছিল খেজুর গাছের ছাল।” [সহিহ মুসলিম]

৬) বালিশ:

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাতে যে বালিশে ঘুমাতেন সেটা ছিল চামড়ার তৈরি। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে বিছানায় ঘুমাতেন সেটাও ছিল চামড়ার তৈরি আর তার ভিতরের জিনিস ছিল খেজুর গাছের ছাল। (মুসনাদ আহমদ-সহিহ)

৭) রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ঘুমের ঘরে অবস্থা দেখে কাঁদলেন উমর রা.

একদা সাহাবিদের এক দল ও উমর রা. রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঘরে প্রবেশ করেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমতাবস্থায় ঘুরে বসলেন, তাতে উমর  রা. তাঁর পার্শ্বদেশ ও মাদুর বা চাটাইয়ের মাঝে কোন কাপড় দেখতে পান নি যার ফলে তাঁর পার্শ্বদেশে মাদুরের দাগ বসে গেছে। তা দেখে ওমর রা. কেঁদে ফেললেন।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রা. বললেন, হে ওমর কেন কাঁদছ?

তিনি উত্তরে বলেন, আমরা জানি আপনি রোম ও পারস্যের রাজার চেয়ে আল্লাহর নিকট অনেক সম্মানী। তারা এ পৃথিবীতে কত প্রকার সুখ আর আনন্দ ফুর্তি করে যাচ্ছে আর আপনাকে আমরা এ অবস্থায় দেখছি!

একথা শুনে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “হে ওমরতুমি কি চাও না যে তাদের জন্য দুনিয়ায় হোক আর আমাদের জন্য হোক আখিরাতে?

ওমর রা. বলেন, হ্যাঁ।

তিনি বলেন, তবে এরূপই হবে। [মুসনাদ আহমদ]

৭) বিতর নামাযের আগে ঘুম:

আয়েশা রা.রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসুল, আপনি কি বিতর নামায পড়ার আগে ঘুমান? তিনি বললেন, হে আয়েশা, আমার চোখ ঘুমালেও অন্তর ঘুমায় না। [বুখারি ও মুসলিম]

প্রেরণা-২২: রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কথা বলার ধরণ

১) আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَالنَّجْمِ إِذَا هَوَىٰ ﴿١﴾ مَا ضَلَّ صَاحِبُكُمْ وَمَا غَوَىٰ ﴿٢﴾ وَمَا يَنطِقُ عَنِ الْهَوَىٰ ﴿٣﴾ إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْيٌ يُوحَىٰ ﴿٤

“নক্ষত্রের কসম, যখন অস্তমিত হয়। তোমাদের সঙ্গী পথভ্রষ্ট হন নি এবং বিপথগামীও হননি। এবং প্রবৃত্তির তাড়নায় কথা বলেন না। কুরআন ওহি, যা প্রত্যাদেশ হয়।” (সূরা নাজম: ১-৪)

২) আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. কে লক্ষ্য করে বলেছেন: তুমি (আমার যে কোন কথা) লিখে রাখ। কারণ, যার হাতে আমার প্রাণ তার শপথ, আমার থেকে সত্য ছাড়া অন্য কিছু বের হয় না। [আবু দাউদ-হাসান]

৩) রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “অল্প শব্দে বেশি অর্থ বোধক কথা বলার যোগ্যতা নিয়ে আমি প্রেরিত হয়েছি। শত্রু বাহিনীর মধ্যে আতংক সৃষ্টির মাধ্যমে আমি বিজয়ী হয়েছি। ঘুমন্ত অবস্থায় আমাকে স্বপ্ন যোগে দেখানো হয়েছে যে, পৃথিবীর ধন-রত্ন ভাণ্ডার সমূহের চাবি এনে আমার সামনে রেখে দেওয়া হয়েছে।” [সহিহ বুখারি]

৪) আয়েশা রা. হতে বর্ণিত। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তোমাদের মত এত তাড়াহুড়া করে কথা বলতেন না। বরং তিনি একটা কথাকে আরেকটা থেকে আলাদা করে স্পষ্ট ভাষায় এমনভাবে কথা বলতেন যে, তার পাশে যারা বসে থাকত তারা তাঁর কথাগুলো মুখস্থ করে ফেলতে পারত। [সহিহ মুসলিম]

৫) তিনি এমনভাবে কথা বলতেন যে, কেউ ইচ্ছা করলে সবগুলো কথা গুণতে পারত। [বুখারি ও মুসলিম]

৬) রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দীর্ঘ সময় নীরব থাকতেন। (আ‏হমদ। সনদ হাসান)

৭) তিনি কোন কোন কথাকে তিনবার করে বলতেন যেন ভালোভাবে বোধগম্য হয়। অন্য বর্ণনায় আছে, যেন কথাগুলো বুঝা যায়। [সহিহ বুখারি]

[অর্থাৎ তিনি দুর্বোধ্য ও কঠিন শব্দ বা বাক্যগুলো তিনবার করে বলতেন।]

৮) রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ব্যাপকার্থ বোধক দুয়াগুলো পছন্দ করতেন; অন্যগুলো বাদ দিতেন।

৯) রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বক্তব্য দেওয়ার রীতি ছিল, তিনি যখন বক্তব্য দিতেন, তার চোখ দুটো লাল হয়ে যেত। আওয়াজ উঁচু হয়ে যেত। তার রাগ প্রচণ্ড আকার ধারণ করত। মনে হত তিনি যেন সেনা বাহিনীকে হুশিয়ার করছেন। [সহিহ মুসলিম]

প্রেরণা-২৩: দুনিয়ার অর্থ-সম্পদের প্রতি অনাগ্রহ

১) আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَلَا تَمُدَّنَّ عَيْنَيْكَ إِلَىٰ مَا مَتَّعْنَا بِهِ أَزْوَاجًا مِّنْهُمْ زَهْرَةَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا لِنَفْتِنَهُمْ فِيهِ ۚ وَرِزْقُ رَبِّكَ خَيْرٌ وَأَبْقَىٰ

“আমি এদের বিভিন্ন প্রকার লোককে পরীক্ষা করার জন্যে পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য স্বরূপ ভোগ-বিলাসের যে উপকরণ দিয়েছি, আপনি সেই সব বস্তুর প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করবেন না। আপনার পালনকর্তার দেওয়া রিজিক উৎকৃষ্ট ও অধিক স্থায়ী।” [সূরা ত্বাহা: ১৩১]

২) ঈলার ঘটনা: উমর ইবনুল খাত্তাব রা. হতে বর্ণিত। ঈলা এর ঘটনায় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কসম খেলেন যে, তিনি তাঁর স্ত্রীদের নিকট একমাস না যাবেন না।

অতঃপর তাদের থেকে আলাদা হয়ে বাড়ির উপর তলায় একটি ঘরে অবস্থান নিলেন। উমর রা. সে ঘরে গিয়ে দেখলেন, তাঁর নিকট সেখানে এক বিশেষ এক প্রকার গাছের পাতা দ্বারা তৈরি থলেতে কিছু খাদ্যদ্রব্য, চামড়ার তৈরি একটি পানির মশক আর একটি ব্যাগে কিছু যব ছাড়া আর কিছু নেই। আর তিনি শুয়ে আছেন খেজুর গাছের তৈরি একটা সাদামাটা চাটাইয়ের উপর। এতে তার শরীরে চাটাইয়ের দাগ পড়ে গেছে। এ অবস্থা দেখে উমর রা. এর চোখ অশ্রু সজল হয়ে উঠল।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম: তোমার কী হল?

উমর রা.: হে আল্লাহর রাসুল, আপনি হলে আল্লাহর সৃষ্টির সেরা মানুষ। (অথচ আপনার এ দৈন্যদশা!) অন্যদিকে কেসরা ও কায়সার তথা পারস্য ও রোমের রাজা-বাদশারা বিত্ত-বৈভবে কত বিলাসী জীবন যাপন করছে!

একথা শুনে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবার উঠে বসলেন। তাঁর চেহারা রক্তিম বর্ণ ধারণ করল।

রা. বললেন, “হে খাত্তাবের বেটা, তুমি কি সন্দেহের মধ্যে আছো?”

অত:পর রা. বললেন, “ওরা তো এমন লোক, দুনিয়ার জীবনেই তাদেরকে অর্থ-সম্পদ, সুখ-সম্ভার অগ্রিম দিয়ে দেওয়া হয়েছে।” [বুখারি ও মুসলিম]

সহিহ মুসলিমের অন্য বর্ণনায় এসেছে, তিনি উমরা রা. কে আরও রা. বললেন, তুমি কি এতে খুশি নও যে, দুনিয়া তাদের জন্য আর আখিরাত আমাদের জন্য?

উমর রা.: হ্যাঁ, হে আল্লাহর রাসুল।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম: “তবে আল্লাহর প্রশংসা কর।”

৩) আলকামা ইবনে মাসউদ রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটা চাটাইয়ের উপর শুয়ে থাকার কারণে তার শরীরে চাটাইয়ের দাগ পড়ে গিয়েছিল। এ অবস্থা দেখে, আমি তার শরীর হাত দিয়ে মুছতে মুছতে বললাম: আমাদেরকে অনুমতি দিলে তো আপনার জন্য কোন কিছু বিছানোর ব্যবস্থা করতাম। তাতে আপনার শরীর রক্ষা পেত। আপনি ও তাতে ঘুমাতে পারতেন।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রা. বললেন, “দুনিয়ার অর্থ-সম্পদ দিয়ে আমার কী হবে? দুনিয়াতে আমার উদাহরণ হল, একজন পথচারীর মত। পথচারী মুসাফির চলার পথে গাছের নিচে ছায়া গ্রহণ করার জন্য আসে। অতঃপর এসব ছেড়ে আবার চলে যায়।” (তিরমিযি-হাসান সহিহ)

৪) রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “আমার নিকট ওহুদ পাহাড় সমান স্বর্ণ থাকলেও আমার নিকট এটাই আনন্দ দায়ক হত যে, তিন দিন অতিবাহিত হওয়ার আগেই (সব এমনভাবে বিলিয়ে দিতাম যে) আমার নিকট সেগুলোর আর কিছুই অবশিষ্ট থাকত না। তবে ঋণ থাকলে তা পরিশোধের জন্য কিছু জমা রাখতাম।” [সহিহ বুখারি]

৫) আমর ইবনে হারিস রা. হতে বর্ণিত। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মৃত্যু বরণ করার সময় কোন দিনার-দিরহাম, দাস-দাসী ইত্যাদি তেমন কিছুই ছেড়ে যাননি। সামান্য কয়েকটি জিনিস রেখে গিয়েছিলেন। সেগুলো হল, তাঁর একটা সাদা খচ্চর যেটাতে তিনি চড়ে বেড়াতেন, একটা অস্ত্র, আর একখণ্ড জমি যা তিনি মুসাফিরের জন্য দান করে গিয়েছিলেন। [সহিহ বুখারি]

প্রেরণা-২৪: রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সাহাবিদের ক্ষুধা-দরিদ্রতা

একদিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বাড়ি থেকে বের হলেন। বাইরে এসে দেখলেন আবু বকর রা. এবং উমর রা. ও তাদের বাড়ির বাইরে এসে বসে আছেন।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম: এ সময় আপনাদের বাড়ি থেকে বের হওয়ার কারণ কি?

আবু বকর রা. ও উমর রা.: ক্ষুধার তাড়নায়, হে আল্লাহর রাসুল।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম: “যার হাতে আমার প্রাণ তার কসম করে বলছি, তোমরা যে কারণে ঘর থেকে বের হয়েছো আমিও একই কারণে বের হয়েছি!”

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে রা. বললেন, “উঠ, চল আমার সাথে।”

তাঁরা এক আনসারী সাহাবির বাড়িতে গেলেন। সাহাবির নাম, আবুল হাইসাম মালিক ইবনে তাইহান। তাঁরা গিয়ে তাঁকে বাড়িতে পেলেন না।

সাহাবির স্ত্রী: (রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তার দুই সাথীকে লক্ষ্য করে) মারহাবা! স্বাগতম!

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম: উমুক (আবুল হায়সাম) কোথায়?

সাহাবির স্ত্রী: তিনি আমাদের জন্য মিঠা পানি আনতে গেছেন।

আবুল হায়সাম রা. ফিরে এসে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তার সাথী দ্বয়ের দিকে তাকালেন তারপর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে রা. বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, আপনার জন্যে আমার মা-বাবা কুরবান হোক।

আবুল হায়সাম: আলহামদু লিল্লাহ! আজ এত সম্মানিত মেহমান আমার ছাড়া আর কারও নেই!

অতঃপর আবুল হায়সাম রা. খেজুর বাগানে গিয়ে গাছ থেকে শুকনা, পরিপক্ব ও আধপাকা খেজুর বিশিষ্ট কয়েকটি ডাল কেটে নিয়ে এলেন।

আবুল হায়সাম: আপনারা এগুলো খান।

খেজুর খেতে দিয়ে তিনি এবার বকরী জবাই করার জন্য ছুরি হাতে নিয়ে ছুটলেন।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম: সাবধান! দুধাল বকরী যেন জবাই না কর।

(বকরী জবাই করে খাদ্য প্রস্তুত হওয়ার পর) রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তাঁর দুই সাথী তৃপ্তির সাথে খেজুর ও গোশত খেলেন এবং মিঠা পানি পান করলেন।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (আবু বকর ও উমর রা. কে লক্ষ্য করে): “সেই সত্ত্বার কসম করে বলছি যার হাতে আমার প্রাণ, কিয়ামতের দিন অবশ্যই আপনাদেরকে এসব নিয়ামতরাজি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। আপনারা ক্ষুধার্ত অবস্থায় বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন। কিন্তু এসব নিয়ামত পাওয়ার পরই এখন ফিরে যাচ্ছেন।” [সহিহ মুসলিম]

প্রেরণা-২৫: রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ক্রন্দন

১) রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বসে আছেন। পাশেই আছেন সাহাবি আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রা.।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম: আমাকে কুরআন পড়ে শুনাও।

ইবনে মাসউদ রা.: আপনাকে কুরআন শুনাবো অথচ কুরআন তো আপনার উপরই অবতীর্ণ হয়েছে?!

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম: আমি অন্যের তিলাওয়াত শুনতে পছন্দ করি।

আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. সূরা নিসা তেলাওয়াত করতে শুরু করলেন। তেলাওয়াতের এক পর্যায়ে যখন এ আয়াতটি পর্যন্ত পৌঁছলেন:

فَكَيْفَ إِذَا جِئْنَا مِن كُلِّ أُمَّةٍ بِشَهِيدٍ وَجِئْنَا بِكَ عَلَىٰ هَـٰؤُلَاءِ شَهِيدًا

“তখন কী অবস্থা হবে যখন প্রত্যেক জাতির মধ্য থেকে একজন করে সাক্ষীকে উপস্থিত করব? আর তোমাকে উপস্থিত করব এ সকল লোকদের সাক্ষী হিসেবে?” [সূরা নিসা: ৪১]

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম: এখন থাম।

ইবনে মাসউদ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দিকে তাকালেন। দেখলেন, তাঁর দু চোখ বেয়ে অঝর ধারায় অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। [বুখারি ও মুসলিম]

২) রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ছেলে ইবরাহিম তার দুধ মার কোলে মৃত্যু মুখে কাতরাচ্ছে। তিনি কয়েকজন সাহাবি সাথে নিয়ে তাকে দেখেতে গেলেন। তিনি ভিতরে এসে বাচ্চাটিকে কোলে তুলে চুমু খাচ্ছেন আর তার ঘ্রাণ নিচ্ছেন।

এরপর সাহাবিগণ ঘরে প্রবেশ করলেন। ঘরে এসে বুঝতে পারলেন, বাচ্চাটির আত্মা বের হচ্ছে। এ অবস্থা দেখে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দু চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল।

সাহাবি আব্দুর রাহমান বিন আঊফ রা.বললেন, হে আল্লাহর রাসুল,আপনি…? (অর্থাৎ আপনি কাঁদছেন?)

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রা. বললেন, এটা দয়া। চোখ অশ্রু সজল হয়। অন্তর ব্যথিত হয়। তবে আমরা শুধু এমন কথাই বলব যা আমাদের প্রতিপালকে খুশি করে।

হে ইবরাহিম, তোমাকে হারিয়ে আমরা মর্মাহত। [বুখারি ও মুসলিম]

প্রেরণা-২৬: রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর স্বপ্ন

১) রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “যে আমাকে স্বপ্ন যোগে দেখল সে যেন বাস্তবে আমাকে দেখল। কারণ শয়তান আমার রূপ ধারণ করতে পারে না।” [সহিহ বুখারি]

২) “যে (স্বপ্নের মাধ্যমে) আমাকে দেখল সে সত্যিই আমাকে দেখল। কারণ শয়তান আমার আকৃতি ধারণ করতে পারে না।” [বুখারি ও মুসলিম]

৩) “যে আমাকে স্বপ্ন মারফত দেখবে সে আমাকে জাগ্রত অবস্থায় দেখবে। কারণ, শয়তান আমার আকার ধারণ করতে পারে না।” [বুখারি ও মুসলিম]

উপরোক্ত হাদিসগুলোর ব্যাখ্যা:

১) হাদিসে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর শরীরের যে রং, গঠন, লম্বত্ব, চুল, দাঁড়ি, পোশাক-পরিচ্ছদ ইত্যাদি বর্ণিত হয়েছে সেভাবে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে স্বপ্নের মাধ্যমে দেখা যেতে পারে।

২) স্বপ্ন মারফত রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে দেখার হাদিসগুলোর ব্যাখ্যায় ইমাম মুনাবী রাহ. বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর যে সব আকার-আকৃতি সহিহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে সেভাবে দেখা হলে তা ঠিক আছে। কিন্তু যদি হাদিসে বর্ণিত বিবরণের ব্যতিক্রম লম্বা, খাটো বা অতিরিক্ত কালো ইত্যাদি গঠনে কেউ দেখে তবে সে প্রকৃতপক্ষে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে দেখে নি।

৩) “যে আমাকে স্বপ্ন মারফত দেখবে সে আমাকে জাগ্রত অবস্থায় দেখবে” এ হাদিসের ব্যাখ্যায় ইমাম মুনাবী রাহ. বলেন, তার মানে হল, সে (কিয়ামতের দিন) রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছাকাছি থেকে তাঁকে দেখবে এবং তাঁর শাফায়াত লাভ করে ধন্য হবে।

৪) উপরোক্ত হাদিসটিকে কেন্দ্র করে কিছু সুফিবাদী লোক দাবী করে থাকে যে, তারা জাগ্রদবস্থায় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে দেখে।

ইবনে হাজার রাহ. তাদের প্রতিবাদে বলেন, “তাই যদি হয় তবে তো তাদেরকে সাহাবি বলতে হয়! আর কিয়ামত পর্যন্ত সাহাবি হওয়ার ধারা অব্যাহত থাকে!! (অথচ এটা কোন মুসলমানের বিশ্বাস হতে পারে না।)

৪) প্রখ্যাত আলেম শাইখ জাকারিয়া আনসারী রাহ. এর নিকট জানতে চাওয়া হয়েছিল, এক ব্যক্তি স্বপ্নে কোন এক মানুষকে দেখে ধারণা করল যে, তিনি হলেন আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তিনি স্বপ্নে তাকে কিছু কাজ করতে আদেশ করছেন। সে কি তা করবে?

তিনি বললেন, ঠিক নয় বরং হারাম।

আলেমগণ দ্ব্যার্থহীনভাবে বলেছেন: স্বপ্নের মাধ্যমে শরিয়তের নতুন কোন বিধিবিধান গ্রহণ করা যাবে না।

৭) কিছু কিছু সুফি-যেমন সূফি সম্রাট ইবনে আরবি প্রমুখ-দাবী করে যে, তারা সরাসরি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে শরিয়তের জ্ঞান আহরণ করে! অথচ শরিয়তকে পরিপূর্ণ করে দেওয়া হয়েছে; তাতে কোন কমতি রাখা হয়নি। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন,

الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا

“আজ তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং আমার নেওয়ামতকে তোমাদের জন্য সমাপ্ত করলাম। আর তোমাদের জন্য ইসলামকে জীবন ব্যবস্থা হিসেবে মনোনীত করলাম। [সূরা মায়িদাহ: ৩]

৮) যারা দাবী করে যে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মৃত্যু বরণ করার পরও তাকে তারা জাগ্রদবস্থায় দেখে তাদের সবচেয়ে বড় জবাব হল আল্লাহ তাআলার এই বাণীটি:

مِن وَرَائِهِم بَرْزَخٌ إِلَىٰ يَوْمِ يُبْعَثُونَ

“আর তাদের পশ্চাতে রয়েছে সুকঠিন প্রাচীর যা কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে।” [সূরা মুমিনূন: ১০০]

প্রেরণা-২৭: শিশুদের প্রতি প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাাইহি ওয়া সাল্লাম-এর স্নেহ, মমতা ও একগুচ্ছ স্নিগ্ধ ভালবাসা

প্রিয় নবী মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ ছিলেন এক মহান আদর্শ মানব। তিনি শুধু নবুওয়ত ও রিসালাতের দায়িত্বপ্রাপ্ত হিসেবে নয় বরং সত্যিকার মানুষ হিসেবে তার মধ্যে যে মানবিক অনন্য সাধারণ গুণাবলীর সমাবেশ ঘটেছিলো তা নি:সন্দেহে বিশ্ববাসীর অনুসরণীয়-অনুকরণীয়। এ পর্যায়ে শিশুদের সাথে তাঁর কোমল আচরণ এবং স্নেহ, মমতা ও ভালবাসার এক অপূর্ব খণ্ড চিত্র দেখব ইনশাআল্লাহ।

◈ ১) জাবের ইবনে সামুরাহ রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, “আমি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাথে ফজরের সালাদ আদায় করলাম। অতঃপর তিনি বাড়ির দিকে বের হলে আমিও তাঁর সাথে বের হলাম। পথিমধ্যে তার সাথে কিছু বাচ্চার সাক্ষাৎ হল। তিনি তাদের এক এক করে প্রত্যেকের উভয় গালে হাত বুলাতে লাগলেন।

মাহমুদ রা. বলেন, তিনি আমার উভয় গালে হাত বুলালেন। আমি তার হাতের শীতল সুগন্ধিময় পরশ উপলব্ধি করলাম-যেন তার হাতের সাথে সুগন্ধি ব্যবসায়ীর সামগ্রীর ছোঁয়া লেগে আছে।” (সহিহ মুসলিম)

◈ ২) উসামার প্রতি তাঁর ভালোবাসা:

উসামা ইবনে যায়েদ রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে ধরে তাঁর এক রানে বসাতেন আর হাসান রা. কে বসাতেন অন্য রানে। অতঃপর তাদের একত্র করে বলতেন, “হে আল্লাহ, তুমি তাদের উভয়ের প্রতি দয়া করো, কেননা আমি তাদের প্রতি দয়া করি।” [সহিহ বুখারি]

অন্য বর্ণনায় এসেছে, “হে আল্লাহ, আমি তাদের ভালোবাসি। সুতরাং আপনিও তাদের ভালবাসুন।” [সহিহ বুখারি]

◈ ৩) মাহমুদ ইবনে রবি এর সাথে তাঁর কৌতুক:

মাহমুদ রা. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এক বারের পানি ছিটানোর কথা, তিনি আমার চেহারায় বালতি থেকে পানি ছিটিয়েছেন। তখন আমার বয়স ছিল পাঁচ বছর যা আমার এখনও মনে আছে।” [সহিহ বুখারি ও মুসলিম]

তিনি এটা করেছেন কৌতুক বশত: বা বরকত স্বরূপ- যেমনটি তিনি সাহাবিদের সন্তানদের সাথে করতেন।

শাইখ ইবনে বায রহ. বলেন, “এটা কৌতুক ও উত্তম চরিত্রের অন্তর্ভুক্ত।”

◈ ৪) শিশুদেরকে আদরের চুমু দেওয়া:

◍ ক. আবু হুরায়রাহ রা. বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাসান ইবনে আলী রা. কে চুম্বন করেন তখন তার নিকট আকরা ইবনে হাবেস তামীমী রা. বসা ছিলেন। আকরা রা. বললেন, “আমার ১০ সন্তান আছে। তাদের কাউকেই আমি চুম্বন করি না।”

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার দিকে তাকিয়ে বললেন, “যে দয়া করে না, তার প্রতি দয়া করা হয় না।” [সহিহ বুখারি]

◍ খ. আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “কিছু গ্রাম্য লোক নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এসে বলল, “তোমরা তোমাদের বাচ্চাদের চুমো খাও কিন্তু আমরা তাদের চুমো খাই না।” নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তোমার অন্তরে দয়া উদ্রেক করা আমার পক্ষে সম্ভব নয় যদি আল্লাহ তা ছিনিয়ে নিয়ে থাকেন।” [সহিহ বুখারি ও মুসলিম]

◈ ৫. হাসান ও হুসাইন রা. এর সাথে তাঁর আদর পূর্ণ ব্যবহার:

◍ ক. হাসান ও হুসাইন রা. রাসূলের সবচেয়ে বেশি প্রিয় ছিলেন। এ ব্যাপারে ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, “আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তাদের সম্পর্কে বলতে শুনেছি, “তারা আমার জন্য পৃথিবীর সুগন্ধিময় দুটি ফুল।” [সহিহ বুখারি]

অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা আমাকে তাদের দান করেছেন এবং তাদের দিয়ে সম্মানিত করেছেন। সন্তানদেরকে চুম্বন করা হয় এবং সুঘ্রাণ নেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে তাদেরকে সুগন্ধময় ফুলের সাথে তুলনা করা হয়েছে।

◍ খ. আবু বাকরাহ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মিম্বারে আরোহণ অবস্থায় তার খুতবা শুনেছি, আর হাসান রা. তাঁর পাশে ছিল। তিনি একবার মানুষের দিকে তাকাচ্ছেন আরেকবার তার দিকে তাকাচ্ছেন এবং বলেছেন, “নিশ্চয়ই আমার এ সন্তান একজন নেতা হবে। সম্ভবত: আল্লাহ তাআলা তাকে দিয়ে মুসলিমদের বিশাল দু দলের মাঝে মীমাংসা করে দেবেন” [সহিহ বুখারি]

পরবর্তীতে আল্লাহ তাআলা তাকে দিয়ে মুআবিয়া রা. ও তার সাথীদের এবং আলী ইবনে আবি তালেব রা. এর অনুসারীদের ও তার সাথীদের মাঝে মীমাংসা করেন। তিনি খেলাফতের দায়িত্ব মুআবিয়া রা. এর জন্য ছেড়ে দেন। ফলে আল্লাহ তআলা তাঁর দ্বারা মুসলিমদেরকে রক্তপাত থেকে রক্ষা করেন।

◍ গ. বারা ইবনে আযেব রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি হাসান ইবনে আলী রা.কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাঁধে দেখেছি এবং বলতে শুনেছি, “হে আল্লাহ, আমি তাকে ভালোবাসি। অতএব, আপনিও তাকে ভালবাসুন।” [সহিহ বুখারি ও মুসলিম]

◈ ৬) সেজদা অবস্থায় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পিঠে বাচ্চার আরোহণ:

শাদ্দাদ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘর থেকে বের হলেন মাগরিব বা এশার নামাজ পড়ানোর জন্য। হাসান রা. বা হুসাইন রা.কে তিনি বহন করছিলেন। অতঃপর তিনি সামনে গিয়ে তাকে রাখলেন। এরপর তিনি নামাজের মধ্যে একটি দীর্ঘ সেজদা করলেন।

আমার পিতা বলেন যে, ‘আমি আমার মাথা উত্তোলন করে দেখতে পেলাম সেজদা রত অবস্থায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাঁধে একটি শিশু। আমি আবার সেজদায় ফিরে এলাম।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম নামাজ সম্পন্ন করলে লোকেরা বলল, “হে আল্লাহর রাসুল, নিশ্চয়ই আপনি নামাজের মধ্যে একটা দীর্ঘ সেজদা করেছেন-যে কারণে আমরা মনে করেছিলা যে, হয়তো কিছু একটা ঘটেছে অথবা আপনার কাছে ওহি এসেছে।”

তিনি বললেন, “এগুলোর কোনটাই হয়নি। তবে আমার সন্তান (হাসান রা./ হুসাইন রা) আমার পিঠে আরোহণ করেছিলো। তাই আমি তার চাহিদা পূরণ না করে তাড়াহুড়ো করতে অপছন্দ করেছি।” [সুনানে নাসায়ী, মুসনাদে আহমদ]

◈ ৭) নামাজরত অবস্থায় জয়নব রা. এর মেয়েকে কোলে তুলে নেওয়া:

আবু কাতাদা থেকে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাজ পড়া অবস্থায় উমামা বিনতে যয়নব রা. কে বহন করছিলেন। যখন তিনি সেজদা করতেন তখন তাকে রেখে দিতেন আর যখন দাঁড়াতেন তখন তাকে কোলে তুলে নিতেন।” [সহিহ বুখারি]

◈ ৮) শিশু বাচ্চারা কাঁদার সময় তাঁর নামাজ সংক্ষিপ্ত করা:

কোনও শিশু বাচ্চার কাঁদার আওয়াজ শুনলে তিনি সালাত সংক্ষিপ্ত করতেন। এ ব্যাপারে আবু কাতাদাহ রা. তার পিতা থেকে, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “যখন আমি সালাতে দাঁড়াই তখন ইচ্ছা থাকে নামায দীর্ঘ করব। কিন্তু যখন কোনও শিশুর কান্নার আওয়াজ শুনি তখন তার মায়ের কষ্ট হবে ভেবে আমি নামাজ সংক্ষেপ করি।” [সহিহ বুখারি]

◈ ৯) উম্মে খালেদের সাথে হাবশি ভাষায় কৌতুক:

এ ব্যাপারে উম্মে খালেদ বিনতে খালেদ ইবনে সাঈদ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “আমি আমার বাবার সাথে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট এলাম। তখন আমার গায়ে হলুদ রঙ্গের জামা ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘‘ছানাহ! ছানাহ!’’ এটি হাবশি ভাষার শব্দ যার অর্থ, চমৎকার! চমৎকার!

তিনি বলেন, “অতঃপর আমি নবুওয়তের মোহর নিয়ে খেলা করতে লাগলে আমাকে আমার পিতা ধমক দিলেন।

কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তাকে ধমক দিও না।”

অতঃপর দুআ বললেন,

أَبلِي وأَخلِقي ثُمَّ أبلِي وَأخلِقي ثُمَّ أبلي وَأخلِقي

“ক্ষয় কর এবং জীর্ণ কর, অতঃপর ক্ষয় কর এবং জীর্ণ কর, অতঃপর আবার ক্ষয় কর এবং জীর্ণ কর।”

আব্দুল্লাহ বলেন, অতঃপর সে মহিলা অনেকদিন জীবিত ছিল। এমনকি তার কথা বর্ণনা করা হতো যে, (যে অমুক দীর্ঘজীবী হয়েছে)। [সহিহ বুখারি]

অর্থাৎ বর্ণনাকারী তার দীর্ঘ জীবনের কথা বুঝিয়েছেন। অনেকে বলেছেন, উম্মে খালেদের মতো আর কেহ এত দীর্ঘ জীবন লাভ করে নি।

◈ ১০) আবু উমায়ের সাথে তার কৌতুক:

আনাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে প্রিয় ছিল আমার এক ভাই। তার নাম আবু উমায়ের। আমার মনে আছে, সে যখন এমন শিশু যে মায়ের বুকের দুধ ছেড়েছে মাত্র। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কাছে আসতেন এবং বলতেন,

“হে আবু উমায়ের,

কী করেছে তোমার নুগায়ের?’

নুগায়ের হল এমন একটি ছোট পাখি যার সাথে আবু উমায়ের খেলা করত। নুগায়ের মারা গিয়েছিল। [সহিহ বুখারি]

◈ ১১) শিশু বাচ্চাদের সালাম দেওয়া:

আনাস ইবনে মালেক রা. থেকে বর্ণিত যে, তিনি শিশু বাচ্চাদের নিকট দিয়ে অতিক্রম করার সময় তাদের সালাম দিতেন এবং বলতেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমনটি করতেন। [সহিহ বুখারি ও মুসলিম]

◈ ১২) রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কোলে শিশুর প্রস্রাব:

উম্মে কায়স বিনতে মিহসান থেকে বর্ণিত, তিনি তার দুগ্ধপোষ্য শিশুকে নিয়ে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দরবারে এলেন। অত:পর তিনি তাকে তাঁর কোলে বসালে সে তাতে প্রস্রাব করে দিলো।

তারপর তিনি পানি নিয়ে আসতে বললেন এবং পানি ছিটিয়ে দিলেন; তা ধৌত করেননি। [সহিহ বুখারি]

◈ ১৩) বড়দের ওপর শিশুদের অগ্রাধিকার দেওয়া:

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার ডান পাশের শিশু ছেলেকে বড়দের আগে শরবত দিয়েছেন।

এ ব্যাপারে সাহল ইবনে সা’দ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এক পেয়ালা শরবত আনা হল। তা থেকে তিনি শরবত পান করলেন এবং তাঁর ডান পাশে ছিল দলের সবচেয়ে ছোট একটি ছেলে। আর বড়রা ছিল তার বাম পার্শ্বে।

তাই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হে ছেলে, তুমি কি আমাকে অনুমতি দেবে যে, আমি তা বড়দেরকে আগে দেব?”

ছেলেটি বলল, “হে আল্লাহর রাসুল, আপনার পক্ষ থেকে আমার অংশ লাভের ব্যাপারে আমি অন্য কাউকে আমার উপর প্রাধান্য দেব না।”

অতএব রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকেই প্রথমে দিলেন। [সহিহ বুখারি]

অন্য বর্ণনায় এসেছে, তিনি ছেলেটিকে বললেন: “তুমি কি আমাকে অনুমতি দিবে এদের দেওয়ার।” ছেলেটি বলল, “না। আল্লাহর কসম, হে আল্লাহর রাসুল, আপনার কাছ থেকে কিছু লাভ করার ব্যাপারে অন্য কাউকে প্রাধান্য দেব না।”

বর্ণনাকারী বলেন অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার হাতে তা রাখলেন।”

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রকৃত অনুসারী হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।

 প্রেরণা-২৮: দাম্পত্য জীবন ও স্ত্রীদের সাথে আচরণ

১) রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, দুনিয়ার পুরোটাই সম্পদ। তবে দুনিয়ার সর্বোত্তম সম্পদ হল: সতী স্ত্রী”। [সহিহ আল-জামে আস-সাগীর, আহমদ, হাদিস: ৬৫৬৭ নাসায়ী, হাদিস: ৩২৩২]

২) আয়েশা রা. বলেন, একদিন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, হে আয়েশ! (সংক্ষিপ্তাকারে) এই যে জিবরাঈল আলাইহিস সালাম তোমাকে সালাম দিচ্ছেন।” [বুখারি ও মুসলিম]

৩) আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, “আমি ঋতুস্রাব অবস্থায় কিছু পান করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দিলে তিনি আমার মুখ রাখার স্থানে মুখ রেখে পান করতেন এবং আমি হাড়ের মাংস খাওয়ার সময় তিনি তা আমার নিকট থেকে নিয়ে আমার মুখ লাগানোর স্থানেই মুখ লাগাতেন।” [সহিহ মুসলিম]

৪) আয়েশা রা. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কোন এক স্ত্রীকে চুমু দিয়ে অজু না করেই নামাযের জন্য মসজিদের উদ্দেশ্যে বের হলেন।”। [মুসনাদ আহমদ ও আবু দাউদ]

৫) রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমর বিন আস রা. এর এক প্রশ্নের উত্তর প্রদান করত: তাকে শিক্ষা দিতে গিয়ে বলেন, স্ত্রীর ভালবাসা, জ্ঞানী, ন্যায়পরায়ণ ও সম্মানিত ব্যক্তিকে কোন ক্রমেই অপমানিত করবে না।

৬) আমর বিন আস রা. হতে বর্ণিত, তিনি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে জিজ্ঞাসা করেন, আপনার নিকট কোন ব্যক্তি সব চেয়ে প্রিয়? তিনি উত্তরে বলেন, আয়েশা। [সহিহ বুখারি ও মুসলিম]

৭) আয়েশা রা. বলেন, আমি ও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক পাত্র হতে পানি নিয়ে গোসল করতাম। [সহিহ বুখারি]

৮) আয়েশা রা. বলেন, আমি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে কোন ভ্রমণে বের হলাম,সে সময় আমি ছিলাম অল্প বয়সী। শারীরিক গঠনের দিক দিয়েও ছিলাম পাতলা। তখনো মোটা তাজা হইনি।

তিনি সাহাবিদেরকে রা. বললেন, তোমরা সামনে যাও, সামনে যাও।

তারা যখন সামনের দিকে অগ্রসর হলে তিনি আমাকে রা. বললেন, “এসো আমরা দৌড় প্রতিযোগিতা করি।”

অত:পর আমি তাঁর সাথে দৌড় প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হলাম। এতে আমি বিজয়ী হলাম।

তিনি সে দিন আমাকে কিছুই বললেন না।

অত:পর পরবর্তীতে আমি শারীরিক দিক দিয়ে মোটা ও ভারী হলে তাঁর সাথে কোন এক সফরে বের হলাম।

তিনি সাহাবিদেরকে রা. বললেন, তোমরা সামনে যাও, সামনে যাও।

তারা সামনে অগ্রসর হলে তিনি আমাকে রা. বললেন, “এসো আমরা দৌড় প্রতিযোগিতা করি।”

এবার তিনি আমার আগে চলে গিয়ে হাসতে হাসতে রা. বললেন, “আজকের জয় সেই দিনের প্রতিশোধ।” [মুসনাদ আহমদ]

৯) ইমাম বুখারি বর্ণনা করেন: রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন খায়বার যুদ্ধ শেষে ফিরছিলেন তখন সফিয়া বিনতে হুয়াই রা. কে বিবাহ করেন।

এবার যে উটের পিঠে সফিয়া রা. আরোহণ করবেন তার চার দিকে ঘুরে পর্দার জন্য কাপড় লাগানোর পর তিনি উটের পার্শে বসে তাঁর হাটুকে খাড়া করে দিলেন। অত:পর সাফিয়া রা. স্বীয় পা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাঁটুর উপর রেখে উঠে আরোহণ করেন। [সহিহ বুখারি]

সে আকৃষ্টকারী দৃশ্যটি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বিনয়ের বহি:প্রকাশ।

১০) আর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতদেরকে যে সব অসিয়ত করেন তন্মধ্যে একটি হল: “তোমরা নারীদের সাথে সদ্ব্যবহার করবে”। [সহিহ বুখারি ও মুসলিম]

পরিশিষ্ট:

১. ইসলাম নির্দেশিত যে সব চারিত্রিক অধ:পতনের কারণে সমাজিক মূল্যবোধ ধ্বংসের পথে

ইসলাম চায় একটি ভালবাসা পূর্ণ, শান্তিময়, মানবিক ও সুন্দর সমাজ ব্যবস্থা উপহার দিতে। তাই এর যাবতীয় উপায়-উপকরণ বলে দেওয়া হয়েছে। তৎসঙ্গে যে সব কারণে দ্বন্দ্ব-কলহ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, সামাজিক অশান্তি, বিদ্বেষ, শত্রুতা এবং মানুষের নৈতিক অধঃপতন ঘটতে পারে সেসব বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে।

কিন্তু দুর্ভাগ্য জনক বাস্তবতা হল যে, বর্তমানে বহু মুসলিম কারণে-অকারণে বা ছোটখাটো বিষয়কে কেন্দ্র করে এসব নিকৃষ্ট স্বভাব-চরিত্র এবং নোংরা আচার-ব্যাবহারের পরিচয় দিচ্ছে। যার কারণে সমাজ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে শান্তি, সম্মান ও শ্রদ্ধবোধ, বন্ধুত্বপূর্ণ সহবস্থানের মনোভাব, আস্থা, বিশ্বাস, সহমর্মিতা, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ। মানুষ হয়ে উঠছে অ সহিষ্ণু, পরস্পরের দুশমন, হিংস্র ও পশুতুল্য। (আল্লাহর নিকট এই পরিস্থিতি থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।)

যাহোক, এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় হল, ইসলামি শিক্ষার বিস্তার এবং ইসলাম নির্দেশিত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, নৈতিকতা এবং আচার-আচরণ চর্চা করা, বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করা এবং ইসলাম প্রদত্ত নৈতিক সৌন্দর্যের রঙ্গিন আলোকচ্ছটায় সমাজের প্রতি কোণ, গৃহাঙ্গণ ও হৃদয়কে রাঙ্গিয়ে দেওয়া। আল্লাহ তওফিক দান করুন। আমিন।

নিম্নে ইসলামের পারস্পারিক আচরণ বিধি এবং সামাজিক মূল্যবোধ ও চরিত্র বিধ্বংসী বৈশিষ্ট্যগুলো সংক্ষেপে তুলে ধরা হল:

✪ ১. অনুমান নির্ভর কথা বলে কাউকে কষ্ট দেওয়া, কারও প্রতি কু ধারণা পোষণ করা এবং তার অসাক্ষাতে গিবত ও সমালোচনা করা:

আল্লাহ তাআলা বলেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اجْتَنِبُوا كَثِيراً مِّنَ الظَّنِّ إِنَّ بَعْضَ الظَّنِّ إِثْمٌ وَلَا تَجَسَّسُوا وَلَا يَغْتَب بَّعْضُكُم بَعْضًا أَيُحِبُّ أَحَدُكُمْ أَن يَأْكُلَ لَحْمَ أَخِيهِ مَيْتًا فَكَرِهْتُمُوهُ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ تَوَّابٌ رَّحِيمٌ

“হে মুমিনগণ, তোমরা অনেক ধারণা থেকে বেঁচে থাক। নিশ্চয় কতক ধারণা গোনাহ। এবং গোপনীয় বিষয় সন্ধান করো না। তোমাদের কেউ যেন কারও পশ্চাতে নিন্দা না করে। তোমাদের কেউ কি তারা মৃত ভায়ের মাংস ভক্ষণ করা পছন্দ করবে? বস্তুত: তোমরা তো তা ঘৃণাই কর। আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ তওবা কবুল কারী ও পরম দয়ালু।” [সুরা হুজুরাত: ১২]

হাদিসে বর্ণিত হয়েছে,

عن أبي هريرة -رضي الله عنه- عن النبي -صلى الله عليه وسلم- قال: «أتدرون ما الغِيبَةُ؟»، قالوا: الله ورسوله أعلم، قال: «ذكرُك أخاك بما يكره»، قيل: أرأيت إن كان في أخي ما أقول؟ قال: «إن كان فيه ما تقول فقد اغْتَبْتَهُ, وإن لم يكن فقد بَهَتَّهُ».

আবু হুরায়রা রা. থেকে মারফু সূত্রে বর্ণিত, “তোমরা কি জান, গিবত কী?

লোকেরা বলল, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসুল ভালো জানেন।’

তিনি বললেন, “তোমার ভাই যা অপছন্দ করে, তাই তার পশ্চাতে আলোচনা করা।”

বলা হল, ‘আমি যা বলি, তা যদি আমার ভাইয়ের মধ্যে থাকে, তাহলে আপনার বক্তব্য কী? (সেটাও কি গিবত হবে?)

তিনি বললেন, “তুমি যা বললে, তা যদি তার মধ্যে তা থাকে, তাহলেই তার গিবত করলে। আর তুমি যা বললে, তা যদি তার মধ্যে না থাকে, তাহলে তাকে অপবাদ দিলে।” [সহিহ মুসলিম]

✪ ২. পারস্পারিক সম্মানহানী, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য, হিংসা-বিদ্বেষ, রাগারাগি, মারামারি, গালাগালি, জুলুম করা:

এ মর্মে কুরআন-হাদিসে যথেষ্ট সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে। নিম্নে এ সংক্রান্ত কতিপয় হাদিস তুলে ধরা হল:

আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

إِيَّاكُمْ وَالظَّنَّ فَإِنَّ الظَّنَّ أَكْذَبُ الحَدِيثِ

وَلاَ تَحَسَّسُوا وَلاَ تَجَسَّسُوا وَلاَ تَنَافَسُوا، وَلاَ تَحَاسَدُوا وَلاَ تَبَاغَضُوا وَلاَ تَدَابَرُوا وَكُونُوا عِبَادَ اللهِ إِخْوَاناً كَمَا أَمَرَكُمْ

المُسْلِمُ أَخُو المُسْلِمِ لاَ يَظْلِمُهُ وَلاَ يَخْذُلُهُ وَلاَ يَحْقِرُهُ التَّقْوَى هاهُنَا التَّقْوَى هاهُنَا وَيُشِيرُ إِلَى صَدْرِهِ

بحَسْبِ امْرِىءٍ مِنَ الشَّرِّ أَنْ يَحْقِرَ أَخَاهُ المُسْلِمَ كُلُّ المُسْلِمِ عَلَى المُسْلِمِ حَرَامٌ : دَمُهُ وَعِرْضُهُ وَمَالُهُ

إنَّ اللهَ لاَ يَنْظُرُ إِلَى أَجْسَادِكُمْ وَلاَ إِلَى صُوَرِكُمْ وَلكِنْ يَنْظُرُ إِلَى قُلُوبِكُمْ وَأَعْمَالِكُمْ

وَفِي رواية لاَ تَحَاسَدُوا، وَلاَ تَبَاغَضُوا وَلاَ تَجَسَّسُوا وَلاَ تَحَسَّسُوا وَلاَ تَنَاجَشُوا وَكُونُوا عِبَادَ اللهِ إِخْواناً

وفي رواية لاَ تَقَاطَعُوا وَلاَ تَدَابَرُوا وَلاَ تَبَاغَضُوا وَلاَ تَحَاسَدُوا وَكُونُوا عِبَادَ اللهِ إِخْواناً

وَفِي رِواية وَلاَ تَهَاجَرُوا وَلاَ يَبِعْ بَعْضُكُمْ عَلَى بَيْعِ بَعْضٍ.

]رواه مسلم بكلّ هذِهِ الروايات، وروى البخاريُّ أَكْثَرَهَا[

‘‘তোমরা কু ধারণা পোষণ করা থেকে বিরত থাক। কারণ কু ধারণা সব চাইতে বড় মিথ্যা কথা।

অপরের গোপনীয় দোষ খুঁজে বেড়ায়ও না।

গোয়েন্দাগিরি করো না।

একে অপরের সাথে (অসৎ কাজে) প্রতিদ্বন্দ্বিতা করো না,

পরস্পরে হিংসা করো না,

পরস্পরে বিদ্বেষ পোষণ করো না,

একে অপরের বিরুদ্ধে শত্রুভাবাপন্ন হয়ো না।

তোমরা আল্লাহর বান্দা, ভাই ভাই হয়ে যাও; যেমন তিনি তোমাদেরকে আদেশ দিয়েছেন। এক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই। সুতরাং

সে তার প্রতি জুলুম করবে না,

তাকে অসহায় অবস্থায় ছেড়ে দেবে না,

এবং তাকে তুচ্ছ ভাববে না।

“আল্লাহ ভীতি এখানে রয়েছে… আল্লাহ ভীতি এখানে রয়েছে…” (এ কথা বলে তিনি নিজ বুকের দিকে ইঙ্গিত করলেন।)

(রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন,)

কোন মুসলমান ভাইকে তুচ্ছ ভাবা একটি মানুষের মন্দ হওয়ার জন্য যথেষ্ট।

প্রত্যেক মুসলমানের রক্ত, সম্ভ্রম ও সম্পদ অপর মুসলমানের উপর হারাম।

নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের দেহ ও আকার-আকৃতি দেখেন না, বরং তিনি তোমাদের অন্তর ও আমল দেখেন।’’

অন্য এক বর্ণনায় আছে, ‘তোমরা পরস্পর হিংসা করো না, পরস্পরের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ পোষণ করো না, অপরের গোয়েন্দাগিরি করো না, একে অপরের গোপনীয় দোষ খুঁজে বেড়ায়ও না, পরস্পরের পণ্যদ্রব্যের মূল্য বাড়িয়ে দিয়ো না। তোমরা আল্লাহর বান্দা, ভাই ভাই হয়ে যাও।’’

আর এক বর্ণনায় আছে, ‘‘তোমরা পরস্পর সম্পর্ক-ছেদ করো না, একে অপরের বিরুদ্ধে শত্রুভাবাপন্ন হইয়ো না, পরস্পরের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ পোষণ করো না, পরস্পর হিংসা করো না। তোমরা আল্লাহর বান্দা, ভাই ভাই হয়ে যাও।’’

অন্য আরও এক বর্ণনায় আছে, ‘‘তোমরা একে অন্যের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করো না এবং অপরের ক্রয়-বিক্রয়ের উপর ক্রয়-বিক্রয় করো না।’’ [এ সবগুলো ইমাম মুসলিম বর্ণনা করেছেন: ৬৭০১-৬৭০৫ এবং এর অধিকাংশ বর্ণনা করেছেন বুখারি: ৫১৪৩, ৬০৬৪, ৬০৬৬, ৬৭২৪]

✪ ৩. রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন,

سِبَابُ الْمُسْلِمِ فُسُوقٌ وَقِتَالُهُ كُفْرٌ

“মুসলিমকে গালি দেওয়া ফাসেকি (পাপাচার) এবং তার সাথে লড়াই করা কুফরি।” [সহিহ মুসলিম]

✪ ৪. রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিদায় হজের ভাষণে বলেন,

إنَّ دِماءكُمْ ، وَأمْوَالَكُمْ ، وأعْرَاضَكُمْ ، حَرَامٌ عَلَيْكُمْ كَحُرْمَةِ يَوْمِكُمْ هَذَا

“নিশ্চয়ই তোমার পরস্পরের রক্ত (জীবন), ধন-সম্পদ ও মান-সম্মান পরস্পরের জন্য হারাম ও সম্মানের যোগ্য, তোমাদের আজকের এ দিনের সম্মানের মতই।” [সহিহ বুখারি ও মুসলিম]

✪ ৫. তিনি আরও বলেন,

لا يَدْخُلُ الجَنَّةَ قَتَّاتٌ

“চোগলখোর তথা পর নিন্দাকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না।” [সহিহ বুখারি ও মুসলিম]

✪ ৬. তিনি আরও বলেছেন,

 سِبَابُ المُسْلِمِ فُسُوقٌ ، وَقِتالُهُ كُفْرٌ

“মুসলিম ব্যক্তিকে গালি দেওয়া পাপ এবং তার বিরুদ্ধে লড়াই করা কুফরি।” [সহিহ বুখারি ও মুসলিম]

এ মর্মে আরও অসংখ্য হাদিস রয়েছে।

আমাদের উচিৎ, ইসলামের এই রত্নতুল্য দিক-নির্দেশনাগুলো নিজেরা অনুসরণ করা, পরিবারে চর্চা করা, শিশুদেরকে প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং সমাজে বিভিন্নভাবে প্রচার-প্রসারের ব্যবস্থা করা।

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে পারস্পারিক হিংসা-বিদ্বেষ, কু ধারণা, ছিদ্রান্বেষণ, অপবাদ, গিবত, চরিত্র গহন, গোপনীয়তা লঙ্ঘণ, ঝগড়া, মারামারি, কাটাকাটি ইত্যাদি নিকৃষ্ট স্বভাব-চরিত্র থেকে হেফাজত করুন এবং ইসলামি সুন্দর ও চারিত্রিক মাধুরী দ্বারা জীবন ও সমাজ গঠনের তাওফিক দান করুন। আমিন।

২. একজন আদর্শ মুসলিমের ব্যক্তিত্ব, চরিত্র ও গুণাবলী

প্রিয় বন্ধু, মুসলিম হওয়া নি:সন্দেহে বিরাট সৌভাগ্যের ব্যাপার। ইসলাম আমাদের গর্ব। ইসলাম আমাদের মর্যাদার প্রতীক। এর মাধ্যমেই এ পার্থিব জগতে যেমন শান্তি ও সাফল্য পাওয়া যাবে ঠিক তদ্রূপ পরকালীন জীবনে পাওয়া যাবে জাহান্নাম থেকে মুক্তির নিশ্চয়তা। কিন্তু আজ অনেক মুসলিম পরিচয় দিতে হীনমন্যতায় ভোগে। এর কারণ, ইসলাম সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকা। ইসলামের সৌন্দর্য মণ্ডিত দিকগুলোর ব্যাপার ওয়াকিবহাল না থাকা। যার কারণে তার মাঝে ইসলামি ব্যক্তিত্বের ছোঁয়া পরিলক্ষিত হয় না।

যাহোক, একজন মুসলিম একদিকে যেমন নির্ভেজাল আকিদা-বিশ্বাস ধারণ করবে, আদর্শিক ভাবে সুন্নাহর অনুসরণে জীবন ঢেলে সাজাবে ঠিক তেমনি আল্লাহর সাথে সম্পর্কের পাশাপাশি মানুষের সাথে সুসম্পর্ক-আচার-আচরণ, উন্নত ব্যক্তিত্ব এবং নৈতিকতায়ও হবে অগ্রপথিক এবং অনন্য ব্যতিক্রমী মানুষ ।

এখানে একজন আদর্শ মুসলিমের ব্যক্তিত্ব, চরিত্র ও গুণাবলী কেমন হওয়া উচিত সে ব্যাপারে ১৩টি পয়েন্টে তুলে ধরা হল:

● ১. মুসলিম ব্যক্তি সর্বদা সত্য কথা বলবে। মিথ্যা কখনই বলবে না।

● ২. সে কখনো প্রতারণার আশ্রয় নিবে না। সে হবে বিশ্বস্ত এবং আস্থা ভাজন।

● ৩. সে অগোচরে কারো সমালোচনা করবে না বা কারো সম্পর্কে খারাপ মন্তব্য করবে না।

● ৪. সে হবে সাহসী। কাপুরুষতাকে সে ঘৃণা করবে।

● ৫. ন্যায়ের পক্ষে সে অত্যন্ত দৃঢ়তার পরিচয় দিবে। সত্য এবং বাস্তব ব্যাপারে দ্বিধা হীনভাবে নিঃসংকোচে কথা বলবে।

● ৬. সে হবে ন্যায়-নিষ্ঠাবান যদিও এতে তার ক্ষতি হয় বা তার বিপক্ষে যায়।

● ৭. সে অন্যের অধিকারে কখনো হস্তক্ষেপ করবে না।

● কেউ তার প্রতি অন্যায় করুক বা জুলুম করুক তা ও সে কখনই বরদাস্ত করবে না।

● ৮. সে হবে শক্তিশালী। অন্যের পক্ষ থেকে সে লাঞ্ছনার শিকার হতে আদৌ রাজি নয়।

● ৯. মুসলিম ব্যক্তি সব কাজে বিজ্ঞজনদের পরামর্শ নিবে। আর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললে মহান আল্লাহর প্রতি ভরসা রেখে সিদ্ধান্তে অবিচল থাকবে।

● ১০. সে তার উপর অর্পিত দায়িত্ব যথাসাধ্য পূর্ণাঙ্গ রূপে পালন করবে।

● সে হবে বিনয়ী এবং দয়ালু।

● ১১. সে সব সময় ভালো এবং জনকল্যাণ মূলক কাজ নিজে করবে এবং অন্যকে তা করার প্রতি উৎসাহিত করবে এবং খারাপ কাজ থেকে দূরে থাকবে এবং অন্যকে তা থেকে নিষেধ করবে।

● ১২. সে আল্লাহর দ্বীনের সাহায্যে সর্বাত্মক চেষ্টা করবে।

● ১৩. একজন মুসলিম নারী হিজাব পরিধান করবে এবং পরপুরুষের সামনে নিজেকে পূর্ণাঙ্গরূপে ঢেকে রাখবে।

অত:এব আসুন, আমরা ইসলামী জীবন আদর্শকে বুকে ধারণ করি এবং সেই আলোকে গড়ে তুলি আমাদের লাইফ স্টাইল এবং ব্যক্তিত্বকে।

মহান আল্লাহ আমাদেরকে প্রকৃত ও আদর্শ মুসলিম হওয়ার তওফিক দান করুন। আমিন।

৩. ইহুদিদের স্বভাব-চরিত্র (২০টি)

কুরআন ও হাদিসে ইহুদিদের অনেক স্বভাব-চরিত্র এবং বৈশিষ্ট্য উল্লেখিত হয়েছে। সেগুলো থেকে নিম্নে অতি সংক্ষেপে ২০টি পয়েন্ট তুলে ধরা হল (কুরআন ও হাদিসের রেফারেন্স সহ): و بالله التوفيق

◒ ১. মুমিন-মুসলিমদের প্রতি সবচেয়ে বেশি শত্রুতা ও বিদ্বেষ পোষণ করা। (সূরা মায়িদা: ৮২)

◒ ২. ধর্মীয় জ্ঞান থাকার পরেও আমল না করা। তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম কে নিজের সন্তানের মতো করে ভালোভাবে চিনতো কিন্তু তারপরও কেবল বিদ্বেষ ও অহংকার বশত তারা তাঁকে রসুল হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। (সূরা বাকারা: ১৪৬ ও সূরা আনআম: ২০)

◒ ৩. চরম একগুঁয়ে, হঠকারী এবং অবাধ্য জাতি। এরা নানা ধরণের আজেবাজে ও পেঁচানো প্রশ্ন করে আল্লাহর হুকুমকে অবজ্ঞা এবং সত্যকে প্রত্যাখ্যান করার চেষ্টা করত। (যেমন: গাভী প্রসঙ্গে নানা অবান্তর প্রশ্ন- সূরা বাকারা: ৭১-৭৬, মাটি থেকে ঝর্ণা বের করে দেখানোর দাবী-সূরা ইসরা: ৯০ এবং আসমানি খবার মান্না-সলওয়া বাদ দিয়ে সবজি, ডাল, পিয়াজ, রসূন ইত্যাদি দাবী করা- সূরা বাকারা: ৬১)

◒ ৪. তাদের কাছে অবতীর্ণ আসমানি কিতাব তাওরাতের বিকৃতি সাধন। (সূরা বাকারা: ৭৬, সূরা: ৪৬ ইত্যাদি)

◒ ৫. দুনিয়ার জীবনকে চরমভাবে ভালোবাসা। (সূরা হাশর: ১৪, সূরা বাকারা: ৯৬ ও সূরা মায়েদা: ২২-২৪)

◒ ৬. সুদ, ঘুষ এবং নানা উপায়ে অন্যায়ভাবে মানুষের সম্পদ ভক্ষণ করা। (মায়েদা: ৪২,মায়েদা: ৬২-৬৩, নিসা: ১৬১ ও সূরা তওবা: ৩৪)

◒ ৭. বিশ্বাসঘাতকতা। (সূরা আনফাল: ৭১)

◒ ৮. পাথরের মত বা পাথরের চেয়েও কঠিন অন্তর। (সূরা বাকারা: ৭৬)

◒ ৯. প্রচণ্ড অহংকারী। (সূরা মায়েদা: ১৮, সূরা বাকরা: ১১১)

◒ ১০. আল্লাহর সম্মানিত রসুল ঈসা আলাইহি সালাত ওয়াস সালাম এর মা মারিয়াম আ. এর প্রতি মিথ্যা অপবাদ। (সূরা মারয়াম: ২৭-২৮ এবং নিসা: ১৫৬-১৫৭)

◒ ১১. অনেক নবী-রসূল এবং যারা সৎকর্মের আদেশ এবং অসৎ কর্মে নিষেধ করতেন তাদেরকে হত্যা করা।

(সূরা আলে ইমরান: ২১, সূরা আলে ইমরান: ১১২)

◒ ১২. অঙ্গীকার এবং চুক্তি ভঙ্গ করা। (সূরা আনফাল: ৫৬)

◒ ১৩. বিভিন্ন দল উপদলে বিভক্ত হওয়া। (সূরা শূরা: ১৪)

◒ ১৪. আল্লাহ এবং তাঁর নবীদের সাথে চরম বেয়াদবি এবং সমাজে নানা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা। (আলে ইমরান: ১৮২ ও সূরা মায়েদা: ৬৪)

◒ ১৫. সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজের নিষেধ থেকে দূরে থাকা। [সূরা শূরা: ১৪]

◒ ১৬. লজ্জাহীনতা। (তারা এক সাথে উলঙ্গ হয়ে গোসল করত এবং একে অপরের লজ্জাস্থান দেখতো। [সহিহ বুখারি ও মুসলিম]

◒ ১৭. মুমিন-মুসলিমদের প্রতি চরম হিংসা পরায়ণ জাতি। (ইহুদিরা মুসলিমদের দুটি জিনিসের প্রতি সবচেয়ে বেশি হিংসা করে। যথা: আমীন বলা ও সালাম দেওয়া।” [সহিহ ইবনে মাজাহ: ৬৭৯, সহিহ তারগিব: ৫১৫]

◒ ১৮. ভীরুতা ও কাপুরুষতা (সূরা হাশর: ১৪)

◒ ১৯. ইলম (জ্ঞান) গোপন রাখা। [সূরা আলে ইমরান: ১৮৭]

◒ ২০. কৃপনতা। [সূরা মায়েদা: ৬৪]

আল্লাহ তাআলা ইহুদিদের এ সকল ঘৃণ্য চরিত্র ও নিকৃষ্ট বৈশিষ্ট থেকে মুসলিম উম্মাহকে রক্ষা করুন। আমীন।

সমাপ্ত

তারিখ: ২০-৭-২০২২ খৃষ্টাব্দ

أَخْلَاق الرَّسُول صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ 

تَأْلِيف : عَبْدِ اللَّهِ الْهَادِي بْنِ عَبْدِ الْجَلِيلِ

আপনার মতামত বা প্রশ্ন লিখুন।