ইমাম ও ইমামতি-৭ম পর্ব

ইমাম ও ইমামতি-৭ম পর্ব

ইমামের ভুল-ত্রুটি (সাজদায়ে সাহুর বিধান)

আব্দুর রাকীব (মাদানী)

দাঈ, দাওয়া’হ সেন্টার খাফজী, সউদী আরব।

সাহু ও সাজদায়ে সাহুঃ

সাহুর আভিধানিক অর্থ, ভুল, অমনোযোগ এবং বেখেয়াল। তাই নামাযে সাহু হওয়া মানে নামায সম্পাদনের সময় ভুলে তথা বেখায়ালে কিছু ছেড়ে দেওয়া বা বেশী করে দেওয়া বা সন্দেহে পড়া। আর সাজদায়ে সাহু হচ্ছে, সেই ভুল সংশোধনের উদ্দেশ্যে সালাম ফিরানোর পূর্বে বা পরে দুটি সাজদা করা।

১-সাজদায়ে সাহুর মাধ্যমে কি ধরণের ভুল সংশোধিত হয়?

নামাযে সংঘটিত ভুলগুলি সমমানের নয়। কিছু ভুল বড় পর্যায়ের, যা সাজদায়ে সাহুর মাধ্যমে সংশোধন হয় না; বরং তা হলে অনেক সময় নামায বাতিল হয়ে যায়, আর অনেক সময় ছুটে যাওয়া সেই কাজটি পুনরায় করা ব্যতীত নামায শুদ্ধ হয় না। এই সব বড় ভুলের উদাহরণ হচ্ছে, নামাযের রুকন ছুটে যাওয়া। সেই রুকন গুলির মধ্যে যদি কেউ তাকবীরে তাহরীমা ভুলে ছেড়ে দেয়, তাহলে তার নামায বাতিল হয়ে যাবে এবং সাজদায়ে সাহুর মাধ্যমে তা পূরণ হবে না। এ ছাড়া অন্য কোনো রুকন ছুটে গেলে, যেমন রুকু কিংবা সাজদা ছুটে গেলে অতঃপর তার পরের রাকাআতের কিরাআত শুরু করার পূর্বে স্মরণ হলে তৎক্ষণাৎ তা করতে হবে এবং তার পরের বাকি কাজও করতে হবে। আর যদি পরের রাকাআত শুরু করার পর স্মরণ হয়, তাহলে যেই রাকাআতে সেই রুকন ছুটে গেছে তা বাতিল হয়ে যাবে এবং তার পূর্বে সংঘটিত রাকাআতটি সেই স্থানে স্থলাভিষিক্ত হবে। [দেখুন, শারহুল মুমতি,৩/৩৭১-৩৭২/ আল্ মুলাখ্খাস আল্ ফিকহী, ড. ফাউযান/৭৫]

এতদ্ব্যতীত নামাযের কোনো ওয়াজিব ভুলে ছুটে গেলে, তা সাজদায়ে সাহুর মাধ্যমে পূরণ তথা সংশোধন হয়ে যায়। যেমন প্রথম তাশাহ্হুদ ছুটে যাওয়া, তকবীরে তাহরীমা ব্যতীত বাকি তাকবীর সমূহের কোনো একটি ছুটে যাওয়া, সামিআল্লাহুলিমান হামিদাহ ভুলে না বলা ইত্যাদি। নবী (সাঃ) একদা প্রথম তাশাহ্হুদ ভুলে ছেড়ে দিলে সাহুর দুটি সাজদা করেন। [আহমদ, ৪/২৫৩, তিরমিযী, আবু দাঊদ ও বায়হাক্বী]

নামাযের সুন্নাহ কিছু ছুটে গেলে সাজদায়ে সাহু দেয়া জরুরী নয়; বরং অনেক উলামার নিকট তা না দেয়াই ভাল। কারণ নামাযের সুন্নাহ ছুটে যাওয়ার ফলে নবী (সাঃ) সাজদায়ে সাহু করেছেন মর্মে কোনো দলীল পাওয়া যায় না। তবে একটি আম (ব্যাপক অর্থবোধক) হাদীস তা বৈধতার ইঙ্গীত করে। নবী (সাঃ) বলেনঃ “প্রত্যেক সাহুর বদলে রয়েছে দু’টি সাজদা”। [ইবনু মাজাহ নং ১২১৯, আবু দাঊদ নং১০৩৮, সূত্র হাসান দেখুন ইরওয়াউল গালীল ২/৪৭]

উল্লেখ থাকে যে, নামাযের রুকন ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় ছুটে গেলে নামায হয় না যতক্ষণে তা না করা হয়। ওয়াজিব ইচ্ছাকৃত ছাড়লে নামায বাতিল হয়ে যায় কিন্তু অনিচ্ছায় ছাড়লে সাজদায়ে সাহুর মাধ্যমে তা সংশোধন হয়ে যায়। আর নামাযের সুন্নাহ ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় ছুটে গেলে নামায বাতিল হয় না, তবে পূর্ণ সওয়াব হতে বঞ্ছিত হয়। [মুলাখ্খাস আল ফিকহী/৬৩]

২-যে সব কারণে সাজদায়ে সাহু বৈধ হয়ঃ

সাধারণতঃ যে সব কারণে সাজদায়ে সাহু করা বৈধ সেগুলো হল তিনটি। যথা:

  • ক-নামাযের কিছু বেশী হওয়া।
  • খ- নামাযের কিছু কম হওয়া।
  • গ- নামাযে সন্দেহ হওয়া। [শারহুল্ মুমতি,৩/৩৩৮]

৩-সাজদায়ে সাহু সালামের পূর্বে না পরে?

অধিকাংশ উলামার মতে সাজদায়ে সাহু সালামের পরে বা পূর্বে দিলে, তা যথেষ্ট হবে এবং নামায শুদ্ধ হবে। কারণ নবী (সাঃ) সাজদায়ে সাহু সালামের পূর্বেও করেছেন এবং পরেও করেছেন। শাওক্বানী বলেনঃ ‘ক্বাযী ইয়ায এবং শাফেয়ীর অনুসারী এক দল বলেনঃ এই সকল মতভেদকারী উলামা এবং অন্যান্য উলামাদের মধ্যে এতে কোনো মতবিরোধ নেই যে, যদি কেউ নামাযের কম বা বেশীর কারণে সালামের পূর্বে বা পরে সাজদায়ে সাহু দেয়, তাহলে তা যথেষ্ট হবে এবং নামায বিনষ্ট হবে না। মূলতঃ তাদের মতভেদ হচ্ছে, উত্তম কি? [সালামের আগে না পরে?] [নায়লুল্ আউত্বার, শাওক্বানী,৩/১৪২/ আর রাউযাতুন্নাদিয়্যাহ, মুহাম্মদ সিদ্দীক হাসান খাঁ,১/৩২৭/শারহুল মুমতি,৩/৩৯৪]

অতঃপর আমাদের জানা ভাল যে, সাজদায়ে সাহু সালামের পূর্বে না পরে, কখন হওয়া উত্তম? এ বিষয়ে ইসলামী পণ্ডিতদের মধ্যে বড় মতভেদ রয়েছে। কম-বেশী আট টি মত পাওয়া যায়।

  • ইমাম আবু হানীফা (রহ) এর মতে সর্বাবস্থায় সাজদায়ে সাহু সালামের পরে হবে। কিন্তু এই মত গ্রহণ করলে সেই সব হাদীস প্রত্যাখ্যান করা হয়, যাতে নবী (সাঃ) সালামের পূর্বে সাহুর সাজদা করেছেন বলে প্রমাণিত।
  • ইমাম শাফেয়ী (রহ) এর মতে সর্বাবস্থায় সাজদায়ে সাহু সালামের পূর্বে হবে। আর এই মত গ্রহণ করলে সেই সব হাদীসের প্রতি আমল হয় না, যেই সব হাদীসে নবী (সাঃ) সালামের পরে সাজদায়ে সাহু করেছেন বলে প্রমাণিত।

তাই এমন একটি সমাধানের পথ হওয়া উচিৎ, যা গ্রহণ করা হলে উভয় প্রকার হাদীসের প্রতি আমল করা সম্ভব হয়। এমন মতকে সমন্বয়সাধনকারী মত বলে। উলামায়ে কেরাম হতে এই রকম দুটি সুন্দর সমন্বয়কারী মত পাওয়া যায়।

প্রথম মতটি ইমাম শাওক্বানীর। তিনি বলেনঃ সে সব স্থানে সালামের পূর্বে সাজদায়ে সাহু করা উত্তম যে সব স্থানে নবী (সাঃ) সালামের পূর্বে করেছেন। অনুরূপ ঐসব স্থানে সালামের পর সাজদায়ে সাহু করা উত্তম যে সব স্থানে নবী (সাঃ) সালামের পর সাজদায়ে সাহু করেছেন। এছাড়া অন্য স্থানে ভুল হলে নামাযী সালামের পূর্বে কিংবা পরে সাজদায়ে সাহু করতে স্বাধীন; কারণ এসব স্থানে কোথায় করতে হবে, তা তিনি (সাঃ) থেকে প্রমাণিত নয়। [নায়লুল আউত্বার,৩/১৪৩]

দ্বিতীয় মতটি ইবনু তায়মিয়াহ এবং ইমাম আহমদের একটি বর্ণনানুযায়ী মত। এই মতানুযায়ী যদি সাজদায়ে সাহু নামাযের কোনো কিছু কমের কারণে হয়, তাহলে সালামের পূর্বে হবে আর যদি কোনো কিছু বেশীর কারণে হয়, তাহলে সালামের পরে হবে। আর সন্দেহের কারণে হলে দুটি অবস্থা হবে। প্রথমতঃ সন্দেহের সময় সঠিক নির্ণয়ে প্রয়াস করতঃ তা নির্ণয় সম্ভব হবে। এমন হলে সালামের পর সাজদায়ে সাহু করতে হবে। উদাহরণ স্বরূপ তিন রাকাআত হল কি চার? এমন হলে তৎক্ষণাৎ সে চেষ্টা চালাবে যে, আসলে কত রাকাআত হল। যদি অনুমানের পাল্লা এক দিকে বেশী হয়, তাহলে সেটিই গণনা করবে। তিনের দিকে মনটা বেশী হলে তিন ধরবে আর চারের দিকে বেশী হলে চার ধরবে। এই নিয়মকে ‘তাহার্রী’ বলে। দ্বিতীয়তঃ সন্দেহের পর কোনো দিকেই অনুমানের পাল্লা বেশী হবে না। যেমন তিন হল কি চার? দুই দিকেই বরাবর সন্দেহ। এমন হলে কম সংখ্যা গণনা করবে। অর্থাৎ তিন রাকাআত ধরবে। এটাকে (আল বিনাউ আলাল্ ইয়াক্বীন) ইয়াক্বীনে প্রতি ভিত্তি করা বলে। এমন হলে সাজদায়ে সাহু সালামের পূর্বে করবে। এই মতানুসারে প্রায় সকল দলীলের প্রতি আমল সম্ভব। এই মতটি আগের মতের তুলনায় বেশী ভাল ও আমলের দিক দিয়ে ব্যাপক কারণ প্রথম মতানুযায়ী যে সব স্থানে সাজদায়ে সাহু প্রমাণিত নেই সেই সব স্থানে ভুল হলে নামাযী আগে বা পরে সাজদায়ে সাহু করতে পারে মর্মে যা বলা হয়েছে তা কোনো দলীলের উপর ভিত্তিশীল নয় কিন্তু দ্বিতীয় মতটি তিন ক্ষেত্রে, কম, বেশী ও সন্দেহের সময় যে সমাধান দেওয়া হয়েছে তাতে যেমন প্রমাণিত স্থানে সাজদায়ে সাহুর প্রতি আমল হয়, তেমন অপ্রমাণিত স্থানে এই সব দলীলের আধারে সমাধান দেওয়া হয়। [আল্লাহই ভাল জানেন]

৪-যে সব কারণে এবং স্থানে নবী (সাঃ) সাজদায়ে সাহু করেছেন, তার বর্ণনাঃ

  • ১-চার রাকাআতের স্থানে পাঁচ রাকাআত পড়া হলে তিনি (সাঃ) সাজদায়ে সাহু সালামের পর করেছেন। আর এটা হচ্ছে নামাযে বেশী হওয়ার উদাহারণ।

عن عبد الله بن مسعود: أن النبي صلى الله عليه و سلم صلّى الظهرَ خمسا فقيل له: أزِيدَ في الصلاةِ؟ فقال: و ما ذاك؟ قالوا: صلّيتَ خمسا، فسجد سجدتين بعدما سلّم. رواه الجماعة.

আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ হতে বর্ণিত, একদা নবী (সাঃ) যহরের নামায পাঁচ রাকাআত পড়ালেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হল, নামায কি বেশী করে দেওয়া হয়েছে? তিনি বললেনঃ এ প্রশ্নের কারণ? সাহাবাগণ বললেনঃ আপনি পাঁচ রাকাআত পড়ালেন। তখন তিনি দুটি সাজদা করলেন সালাম ফিরানোর পর”। [বুখারী, স্বালাত অধ্যায়, অনুচ্ছেদ নং ৩২, হাদীস নং (৪০৪)/ মুসলিম, মাসাজিদ অধ্যায়, নং (১২৮১)]

অন্য বর্ণনায় এসেছে, এটা শুনার পর তিনি (সাঃ) তাঁর দুই পায়ে বসলেন এবং কিবলামুখী হলেন। অতঃপর দুটি সাজদা করলেন তারপর সালাম ফিলালেন”। [বুখারী, স্বালাত অধ্যায়, নং (৪০১)]

  • ২-চার রাকাআতের স্থানে দুই রাকাআত পড়ে সালাম ফিরালে কিংবা চার রাকাআতের স্থানে তিন রাকাত পড়ে সালাম ফিরালে, নবী (সাঃ) বাকি রাকাআত সালামের পর পূর্ণ করেন এবং সালাম ফিরান তারপর সাজদায়ে সাহু করেন। বাহ্যত এটা নামাযে কম হওয়ার উদাহারণ মনে হলেও ঐ সকল উলামা এটাকে নামাযে বেশী করার উদাহারণ মনে করেছেন, যারা নামাযের কোনো কিছু বেশী হলে সালাম ফিরানোর পর সাজদায়ে সাহু হবে বলে মত ব্যক্ত করেছেন। তাদের মতে বর্তমান অবস্থায় সে নামায পূর্ণ করার পূর্বে সালাম ফিরিয়েছে যা, মূলতঃ নামাযে বেশী করা। [শারহুল মুমতী,৩/৩৪১]

ক-আবু হুরাইরা (রাযিঃ) হতে বর্ণিত, একদা আল্লাহর রাসূল (সাঃ) আমাদের যহর কিংবা আসরের নামায পড়ালেন। তিনি দুই রাকাআত পড়িয়ে সালাম ফিরালেন। [কিছু লোক বলাবলি করতে লাগলো, নামায মনে হয় কম করে দেওয়া হয়েছে!] লোকদের মধ্যে এক ব্যক্তি ছিল, যাকে যুল ইয়াদাঈন বলা হত। সে নবী (সাঃ) কে বললঃ আপনি কি ভুলে গেলেন না নামায কম হয়ে গেছে? তিনি (সাঃ) বললেনঃ না আমি ভুলেছি আর না কম করা হয়েছে। অতঃপর তিনি (সাঃ) বাকি লোকদের বললেনঃ যুল্ ইয়াদাঈন কি ঠিক বলছে? তারা বললঃ হাঁ। অতঃপর তিনি (সাঃ) বাকি নামায আদায় করলেন। তারপর সালাম ফিরালেন। তারপর তকবীর দিলেন এবং তাঁর সাজদার মত সাজদা করলেন বা তার চেয়েও একটু দীর্ঘ সাজদা। তারপর তাঁর মাথা উঠালেন এবং তকবীর দিলেন। অতঃপর তকবীর দিয়ে সাজদা করলেন তাঁর সাজদার মত কিংবা তার থেকেও একটু দীর্ঘ সাজদা। তারপর তাঁর মাথা উপরে উঠালেন এবং তকবীর দিলেন। অতঃপর সালাম ফিরালেন”।  [বুখারী, সাহু অধ্যায়, নং১২২৯/মুসলিম, মাসাজিদ অধ্যায়, সাহু অনুচ্ছেদ, নং ১২৮৮]

খ-ইমরান বিন হুসাঈন হতে বর্ণিত, একদা নবী (সাঃ) আসরের নামায তিন রাকাআত পড়িয়ে সালাম ফিরান এবং নিজ বাসস্থানে প্রবেশ করেন। অতঃপর খিরবাক নামক ব্যক্তি তাঁকে এটা অবগত করালে তিনি (সাঃ) রাগান্বিত অবস্থায় বাসা থেকে বের হয়ে লোকদের মাঝে উপস্থিত হলেন এবং জিজ্ঞাসা করলেনঃ একি সত্য বলছে? তারা বললঃ হাঁ! অতঃপর তিনি (সাঃ) এক রাকাআত নামায পড়লেন এবং সালাম ফিরালেন। তারপর দুটি সাজদা করলেন এবং সালাম ফিরালেন”। [মুসলিম, মাসাজিদ অধ্যায়, সাহু অনুচ্ছেদ, নং (১২৯৩)/আবু দাঊদ নং (১০১৮) নাসাঈ নং (১২৩৬) ইবনু মাজাহ নং (১২১৫)]

  • ৩-প্রথম তাশাহ্হুদ [চার রাকাআত বা তিন রাকাআত বিশিষ্ট নামাযের দুই রাকাআত শেষে তাশাহ্হুদ] ছুটে গেলে, নবী (সাঃ) সালামের পূর্বে সাজদায়ে সাহু করেন অতঃপর সালাম ফিরান। এখানে নামাযের অংশ কম হওয়ায় সাজদায়ে সাহু সালামের পূর্বে হবে।

আব্দুল্লাহ বিন বুহাইনা (রাযিঃ) হতে বর্ণিত, একদা নবী (সাঃ) তাদের যহরের নামায পড়ান। প্রথম দুই রাকাআত শেষে না বসেই উঠে যান। লোকেরাও তাঁর সাথে উঠে পড়েন। যখন নামায শেষ হয় এবং লোকেরা তাঁর সালাম ফিরানোর অপেক্ষা করতে লাগে, তিনি (সাঃ) বসা অবস্থায় তকবীর দেন, সালামের পূর্বে দুটি সাজদা করেন অতঃপর সালাম ফিরান”। [বুখারী, সাহু অধ্যায়, নং (১২২৪-১২২৫)/নাসাঈ, নং (১১৭৬)]

উপরোক্ত অবস্থায় ইমাম যদি পুরোপুরি দাঁড়ানোর পূর্বে তাঁর এই ভুল জানতে পারে, তাহলে বসে পড়বে। আর পুরো দাঁড়িয়ে যাওয়ার পর জানতে পারলে বসবে না। বরং সাজদায়ে সাহু করবে। [আবু দাঊদ, স্বালাত অধ্যায়, নং (১০৩৬) ইবনু মাজাহ, নং (১২০৮)]

  • ৪-নামাযের রাকাআত সংখ্যায় সন্দেহ হওয়ার পর কোনো এক দিকে ধারনা প্রবল হলে, নবী (সাঃ) সাজদায়ে সাহু সালামের পর করতে বলেছেন। যেমন কারো সন্দেহ হল, তিন রাকাআত হল কি চার? অতঃপর অনুমান তিনের দিকে বেশী হল, তখন তা তিনই ধরতে হবে এবং এই সন্দেহের কারণে সালামের পর সাজদায়ে সাহু করতে হবে।

নবী (সাঃ) বলেনঃ “তোমাদের কেউ নামাযে সন্দেহে পড়লে সে যেন সঠিক নির্ণয়ে চেষ্টা করে এবং তা করে। অতঃপর সে যেন সালাম ফিরায় এবং তার পর দুটি সাজদা করে”। [বুখারী, স্বালাত অধ্যায়, নং (৪০১) মুসলিম, নং (১২৭৪)]

  • ৫- নামাযের রাকাআত সংখ্যায় সন্দেহ হওয়ার পর কোনো এক দিকে ধারনা প্রবল না হলে, কম সংখ্যা ধরতে হবে এবং এই রকম ক্ষেত্রে সাজদায়ে সাহু সালামের পূর্বে হবে। যেমন কারো সন্দেহ হল যে, দুই রাকাআত পড়েছে কি তিন? আর কোনো দিকেই অনুমান বেশী হয় না। এমন ক্ষেত্রে কম সংখ্যা গণনা করতে হবে অর্থাৎ দুই রাকাআত ধরতে হবে এবং সালামের পূর্বে সাজদায়ে সাহু করতে হবে।

আবু সাঈদ খুদরী (রাযিঃ) হতে বর্ণিত, নবী (সাঃ) বলেছেনঃ “যখন তোমাদের মধ্যে কেউ নামাযে সন্দেহে পড়বে আর জানতে পারবে না যে, সে তিন রাকাআত পড়লো না চার রাকাআত, তাহলে সে যেন সন্দেহকে প্রত্যাখ্যান করে আর যাতে সন্দেহ নেই তার উপর ভিত্তি করে। অতঃপর সালামের পূর্বে সে যেন দুটি সাজদা দেয়। যদি তার অবস্থা এমন হয় যে, সে পাঁচ রাকাআত পড়েছে, তাহলে (সেই দুটি সাজদা) তার নামাযকে জোড়া করে দিবে। আর যদি সে চার রাকাআত পূরণার্থে পড়েছে, তাহলে সেই দুটি সাজদা শয়তানকে লাঞ্ছিত করা স্বরূপ হবে”। [মুসলিম, মাসাজিদ অধ্যায়, নামাযে সাহু অধ্যায়, নং ১২৭২/মুসনাদ আহমদ,৩/৭২]

উপরের বর্ণনাসমূহের সারাংশঃ

উপরে বর্ণিত হাদীস সমূহ থেকে নবী (সাঃ) এর যে সব স্থানে সাহু হয়েছে, তার বিবরণ নিম্নরূপঃ

  • ১-চার রাকাআতের স্থানে পাঁচ পড়েছেন এবং এমন সময় তিনি (সাঃ) সাজদায়ে সাহু সালামের পর করেছেন।
  • ২-চার রাকাআতের স্থানে দুই রাকাআত পড়ে সালাম ফিরিয়েছেন অনুরূপ চার রাকাআতের স্থানে তিন রাকাআত পড়িয়ে সালাম ফিরিয়েছেন এবং এই সময়ে তিনি (সাঃ) সালাম ফিরানোর পর সাজদায়ে সাহু করেছেন।
  • ৩-প্রথম তাশাহ্হুদ না পড়েই তৃতীয় রাকাআতের জন্য উঠে পড়েছেন। এমতবস্থায় তিনি (সাঃ) সাজদায়ে সাহু সালামের পূর্বে করেছেন।
  • ৪ এবং ৫-নামাযের রাকাআত সংখ্যায় সন্দেহ হওয়া অতঃপর কোনো এক সংখ্যার দিকে একীন হওয়া কিংবা না হওয়া। এই দুই স্থানে তাঁর সাহু হয়েছে বলে প্রমাণ নেই কিন্তু তাঁর হাদীস রয়েছে। সন্দেহের পর কোনো এক সংখ্যার দিকে অনুমান বেশী হলে তিনি (সাঃ) সাজদায়ে সাহু সালামের পর করতে বলেছেন। আর সন্দেহের পর দুই সংখ্যার কোনো দিকেই একীন না হলে কম সংখ্যা ধরতে বলেছেন এবং এই সময় তিনি (সাঃ) সাজদায়ে সাহু সালামের পূর্বে করতে বলেছেন।

তাই উপরোক্ত স্থানে সাহু হলে বর্ণনানুযায়ী সালামের আগে বা পরে সাজদায়ে সাহু করা উত্তম। আর অন্য স্থানে সাহু হলে দেখতে হবে সেই সাহু উপরোক্ত কোন্ সাহুর সাথে মিল রাখে? অতঃপর সেই অনুযায়ী আগে বা পরে সাজদায়ে সাহু করতে হবে। আর কেউ যদি তা নির্ণয় করতে সক্ষম না হয়, তাহলে আগে বা পরে যে কোনো সময় সাজদায়ে সাহু করা বৈধ হবে ইন্ শাআল্লাহু তাআ’লা।

৫-সাজদায়ে সাহু করার নিয়মঃ

সাজদায়ে সাহুর পূর্বে তকবীর দিয়ে ঐ ভাবে দুটি সাজদা করতে হবে যেভাবে নামাযে সাজদা করা হয়। এই সময় নামাযের সাজদার যা বিধান, তা এই সাজদায়েও প্রযোজ্য। [উপরোক্ত দলীলগুলির আলোকে]

৬-ইমাম সাজদায়ে সাহু করলে মুক্তাদীদেরও সাজদায়ে সাহু করতে হবে; কারণ মুক্তাদীগণ ইমামের অনুসরণ করতে আদিষ্ট। কিন্তু ইমামের পিছনে মুক্তাদীর সাহু হলে, মুক্তাদী পৃথক ভাবে সাজদায়ে সাহু করবে না। এ বিষয়ে ইবনুল মুনযির ঐক্যমত বর্ণনা করেছেন। [আল্ ইজমা, ইবনুল মুনযির, পৃ ৮]

৭-সাজদায়ে সাহুর জন্য ভিন্ন তাশাহ্হুদঃ

সাজদায়ে সাহুর পরে আবার আলাদা কোনো তাশাহ্হুদ নেই। এ বিষয়ে ইমরান বিন হুসাইন থেকে যেই হাদীস আবু দাঊদ ও তিরমিযীতে বর্ণিত হয়েছে যে, “একদা নবী (সাঃ) নামাযে সাহু করেন এবং দুটি সাজদা করেন। অতঃপর তাশাহ্হুদ করেন তারপর সালাম ফিরান”, তা অসংরক্ষিত বর্ণনা; বরং সংরক্ষিত সহীহ বর্ণনায় (অতঃপর তাশাহহুদ করেন) শব্দটি নেই। উক্ত শব্দটিকে বায়হাকী, ইবনু আব্দুল বার্র, ইবনু হাজার এবং আলবানী (রাহেমাহুমুল্লাহ) ‘শায’ বলেছেন। অর্থাৎ সৎ রাভির এমন বর্ণনা যা, তিনি তার থেকে অধিক সৎ বর্ণনাকারীর বিপরীত বর্ণনা করেছেন।[ইরওয়াউল গালীল,২/১২৮]

প্রকাশ থাকে যে, তাহিয়্যা পড়ার পর এক দিকে এক সালাম ফিরানোর পর সাজদায়ে সাহু করার কোনো সহীহ হাদীস পাওয়া যায় না।

৮-একই নামাযে একাধিক সাহু হলে, একাধিক সাজদায়ে সাহু নয়; বরং এক বার সাজদায়ে সাহু যথেষ্ট হবে। নবী (সাঃ) এর সাহুতে একাধিক সাহু ঘটেছিল, যেমন রাকাআত কম হওয়া, নামাযের পূর্বে সালাম ফিরিয়ে দেওয়া অতঃপর অন্যের সাথে বাক্যালাপ করা, তার পরেও তিনি এক বারই সাজদায়ে সাহু দেন।[বুখারী, সাহু অধ্যায়, নং১২২৯/মুসলিম, মাসাজিদ অধ্যায়, সাহু অনুচ্ছেদ, নং ১২৮৮]

চলবে ইনশাআল্লাহ

 

 

2 thoughts on “ইমাম ও ইমামতি-৭ম পর্ব

Leave a reply to jannati Cancel reply