আহলে হাদীসগণের আকীদা এবং মূলনীতি:
পড়ুন:
ভারতবর্ষে আহলে হাদীসদের প্রকৃত ইতিহাস-১ম পর্ব
ভারতবর্ষে আহলে হাদীসদের প্রকৃত ইতিহাস-২য় পর্ব
ভারতবর্ষে আহলে হাদীসদের প্রকৃত ইতিহাস-৩য় পর্ব
১) তাওহীদ:
আহলে হাদীসগণ বিশ্বাস করে যে, তাওহীদ হল দ্বীনের মূল ভিত্তি। তারা তাদের কার্যক্রম শুরু করে খালেস তাওহীদের মাধ্যমে। এই তাওহীদকে মানুষের হৃদয়পটে প্রোথিত করার জন্য তারা চেষ্টা করে। তাওহীদের তিন প্রকারের মধ্যে বিশেষ করে তাওহীদে উলূহিয়ার ব্যাপারে আহলে হাদীসগণ সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব প্রদান করে। কেননা, এ প্রকার তাওহীদের ব্যাপারেই অধিকাংশ মানুষ ভুলে নিমজ্জিত। যদিও তারা তাওহীদে রুবুবিয়ায় বিশ্বাস করে যার দাবী হল, শাসন ক্ষমতা ও সার্বভৌমত্ব একমাত্র আল্লাহর।
আহলে হাদীসগণ কেবল রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠায় বিশ্বাস করাকেই যথেষ্ট মনে করে না বরং বিশ্বাস করে, মানুষের ব্যক্তি জীবন, আচার-আচরণ, লেনদেন, চিন্তা-চেতনা থেকে শুরু করে আইন ও সংবিধান প্রণয়ন ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা তথা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহ তায়ালাই একমাত্র হুকুম দাতা।
২) ইত্তিবা:
আহলে হাদীসগণ সালাফে-সালেহীনের বুঝ ও ব্যাখ্যার আলোকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বিশুদ্ধ সূত্রে প্রমাণিত হাদীস অনুসরণের প্রতি অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করে। যার কারণে, তারা অন্ধ তাকলীদ তথা দলীল জিজ্ঞেস করা ছাড়া বিশেষ মাযহাব গ্রহণ করাকে সঠিক মনে করে না। বরং তারা যে ব্যক্তির মধ্যে ইজতিহাদের শর্তাবলী বিদ্যমান রয়েছে তার জন্য ইজতিহাদের দরজা উন্মুক্ত করার প্রতি আহবান করে।
সাধারণ মানুষ সেভাবেই আমল করবে যেভাবে যোগ্য আলেমগণ সালাফে-সালেহীনের বুঝ ও ব্যাখ্যার আলোকে কুরআন-সুন্নাহ ভিত্তিক ফতোয়া প্রদান করবেন।
আহলে হাদীসগণ আলেমদেরকে বিশেষ করে প্রচলিত মাযহাব সমূহের মহামতি ইমামগণকে বিশেষভাবে সম্মান ও শ্রদ্ধা করার আহবান জানায়।
৩) তাকদীমুন নকলি আলাল আকল (যুক্তির উপর দলীলকে প্রাধান্য দেয়া):
আহলে হাদীসদের মূলনীতির অন্তর্ভূক্ত হল, রায়, কিয়াস বা যুক্তির উপর দলীলকে প্রাধান্য দেয়া । অর্থাৎ যখনই কোন রেওয়ায়াত বা দলীল পাওয়া যাবে তখন সেখানে ব্যক্তি-বিশেষের রায় বা মতামত ও যুক্তি উপর সেই দলীলকে অগ্রাধিকার প্রদান করতে হবে। এটা আহলে হাদীসদের একটি অন্যতম নীতি। কারণ, তারা মনে করে সুস্থ বিবেক-বুদ্ধির সাথে বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত শরীয়তের দলীল সাংঘর্ষিক হতে পারে না। সেহেতু শুধু যুক্তি ও বিবেক-বুদ্ধি দ্বারা শরীয়তের কোন বিষয়ের বিরুদ্ধাচরণ করা কিংবা শরীয়তের উপর যুক্তি ও বিচার-বুদ্ধিকে অগ্রাধিকার প্রদান করা বৈধ নয়।
৪) তাযকিয়ায়ে নফস বা আত্মশুদ্ধি:
মানুষের মন-মনন, চিন্তা ও চেতনাকে পরিশুদ্ধ করার জন্য কুরআন-সুন্নাহ নির্দেশিত বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করা আহলে হাদীসগণের অন্যতম রীতি। তবে তারা বিভিন্ন সূফী তরীকায় আত্মশুদ্ধির বিরোধিতা করে।
৫) বিদআত থেকে সাবধান:
আহলে হাদীসগণের আরেকটি রীতি হল,বিদআত থেকে মানুষকে সতর্ক করা। কারণ, তারা মনে করে বিদআত করা মানে স্বয়ং আল্লাহর ত্রুটি অনুসন্ধান করে মানবিক বিবেক-বুদ্ধির আলোকে শরীয়তে সংযোজন করা। যার কারণে, তারা সুন্নতকে দৃঢ়ভাবে ধারণ ও সকল প্রকার বিদআত বর্জন করার প্রতি আহবান জানায়।
৬) যঈফ ও মওযূ হাদীস থেকে সতর্ক করা:
যঈফ (দূর্বল) ও মওযূ (বানোয়াট বা জাল) হাদীস থেকে সতর্ক করা আহলে হাদীসগণের একটি অন্যতম রীতি। কারণ, মুসলিম উম্মাহর উপর এ জাতীয় হাদীসের কুফল অত্যন্ত ভয়াবহ। এই জন্য আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নামে কোন হাদীস বলা হলে সে ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে তা যদি আকীদা ও আহকামের ব্যাপারে হয়।
৭) জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ:
আহলে হাদীসগণ বিশ্বাস করে, আল্লাহর পথে জিহাদ করা অন্যতম শ্রেষ্ঠ আমল। পৃথিবীর বুকে আল্লাহর কালিমাকে বুলন্দ করা ও বিশৃঙ্খলা প্রতিহত করতে এই জিহাদ কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّىٰ لَا تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ كُلُّهُ لِلَّـهِ
“তাদের সাথে লড়াই অব্যহত রাখো যত দিন না ফিতনা নির্মূল হয় ও দ্বীন পরিপূর্ণভাবে আল্লাহর জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়।“ (সূরা আনফান: ৩৯)
৮) রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামী আইন বাস্তবায়ন করা:
আহলে হাদীসগণ শরীয়ত সম্মত পন্থায় ব্যক্তিগত,সামাজিক, রাজনৈতিক,অর্থনৈতিক তথা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামী শরীয়তকে মূল ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করে।
আহলে হাদীসগণ বিশ্বাস করে,বিশ্ব চরাচরের একচ্ছত্র অধিপতি মহান আল্লাহ তায়ালার খালেস তাওহীদ ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নত ও আদর্শ মোতাবেক আমল করার মাধ্যমেই পৃথিবীতে বিজয় ও ক্ষমতা অর্জন করা সম্ভব। কারণ, এ দুটি জিনিস যেমন আমল কবুল হওয়ার শর্ত তদ্রূপ পৃথিবীতে শাসন কর্তৃত্ব, বিজয় ও ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠারও শর্ত। আল্লাহ তায়ালা এ দুটি শর্ত সাপেক্ষেই শাসন কর্তৃত্ব ও খিলাফতের দায়িত্ব প্রদানের ওয়াদা করেছেন। তিনি বলেন,
وَعَدَ اللَّـهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنكُمْ وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِي الْأَرْضِ كَمَا اسْتَخْلَفَ الَّذِينَ مِن قَبْلِهِمْ وَلَيُمَكِّنَنَّ لَهُمْ دِينَهُمُ الَّذِي ارْتَضَىٰ لَهُمْ وَلَيُبَدِّلَنَّهُم مِّن بَعْدِ خَوْفِهِمْ أَمْنًا ۚ يَعْبُدُونَنِي لَا يُشْرِكُونَ بِي شَيْئًا ۚ وَمَن كَفَرَ بَعْدَ ذَٰلِكَ فَأُولَـٰئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ
“তোমাদের মধ্যে যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে, আল্লাহ তাদেরকে ওয়াদা দিয়েছেন যে,তাদেরকে অবশ্যই পৃথিবীতে শাসন কৃর্তৃত্ব দান করবেন। যেমন তিনি শাসন কর্তৃত্ব দান করেছেন তাদের পূর্ববর্তীদেরকে এবং তিনি অবশ্যই সুদৃঢ় করবেন তাদের ধর্মকে, যা তিনি তাদের জন্যে পছন্দ করেছেন এবং তাদের ভয়-ভীতির পরিবর্তে অবশ্যই তাদেরকে শান্তি ও নিরাপত্তা দান করবেন। তারা আমার এবাদত করবে এবং আমার সাথে কাউকে শরীক করবে না। এরপর যারা অকৃতজ্ঞ হবে, তারাই অবাধ্য।” (সূরা নূর: ৫৫)
এ কারণে আহলে হাদীসগণ শরীয়ত সম্মত সম্ভাব্য সকল উপায়-উপকরণ ব্যবহার করে এ লক্ষ্যে দাওয়াতি কাজ করছে,যেন তাওহীদকে শিরক-বিদআতের পঙ্কিলতা, আকীদা ও আচরণগত ভ্রান্তির কলুষ থেকে মুক্ত করা যায়। সেই সাথে প্রচলিত বানোয়াট হাদীসগুলোকে সহীহ হাদীস থেকে পরিচ্ছন্ন কুরআন-সুন্নাহর অনুসারী সুস্থ ও বিশুদ্ধ আকীদা সম্পন্ন একটি জাতি গঠন করা যায়।
৯) বাতিল ফিরকা ও দল-উপদলের প্রতিবাদ:
আহলে হাদীসগণ বৈধ সম্ভাব্য সকল উপায়ে ইসলামের নামে গোমরাহ বিভিন্ন ফিরকা ও দল-উপদলের প্রতিবাদ করে থাকেন। যেমন শিয়া, কাদিয়ানী, ব্রেলভী, বাহাঈ ইত্যাদি।
অনুরূপভাবে তারা ইসলাম বিধ্বংসী বিভিন্ন সমকালীন মতবাদেরও প্রতিবাদ করেন। যেমন ধর্ম নিরপেক্ষতা, পুঁজিবাদ, কম্যুনিজম, সোশ্যালিজম ইত্যাদি।
আহলে হাদীসগণের আকীদা ও আদর্শগত ভিত্তি:
- আহলে হাদীসগণ আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের আদর্শের আলোকে পূর্ববর্তী মুহাদ্দিস ও ফকীহগণের রীতি অনুসারে কুরআন-সুন্নাহ থেকে আকীদা ও আহকাম গ্রহণ করে থাকে।
- তারা সাধারণভাবে পূর্ববর্তী মনিষীদের বিশেষত: ইমাম আহমদ বিন হাম্বল, শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া, ইমাম ইবনুল কাইয়েম জাওযিয়া, ইমাম মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওয়াহাব প্রমুখের গ্রন্থাদি অধ্যয়নের প্রতি জোর দিয়ে থাকেন।
- অনুরূপভাবে আধুনিক যুগের সালাফী দাওয়াতের পথিকৃৎ সউদী আরবের সাবেক গ্র্যান্ড মুফতি শাইখ আল্লামা আব্দুল আজীজ বিন বায রহ., যুগ শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস আল্লামা নাসিরুদ্দীন আলবানী রহ. প্রমুখের গ্রন্থাদি প্রচার ও প্রসার করে থাকে।
আহলে হাদীসদের সম্প্রসারণ এবং অবস্থান:
আহলে হাদীস জামায়াত ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল, কাশ্মীর, শ্রীলংকা এবং ফিজি দ্বীপপুঞ্জ ইত্যাদি এলাকায় সম্প্রসারিত। ব্রিটেনেও তাদের শাখা রয়েছে। এ সকল এলাকায় তারা জমঈয়তে আহলে হাদীস নামে পরিচিত। উক্ত দেশগুলোর প্রত্যেকটিতেই জমঈয়তের কেন্দ্র রয়েছে এবং প্রদেশ ও জেলা ভিত্তিক তাদের শাখা রয়েছে। প্রত্যেক দেশের নেতৃত্ব সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন। কিন্তু এটা কেবল সাংগঠনিক প্রক্রিয়া মাত্র। প্রকৃতপক্ষে সালাফী মূলনীতি ও আদর্শে তারা এক ও অভিন্ন।
জমঈয়তে আহলে হাদীস ভারত উপমহাদেশের বাইরের একই মূলনীতি ও আদর্শে বিশ্বাসী অন্যান্য সংঘ ও সংগঠনের সাথেও সম্পর্ক রাখে। যেমন, জামায়াতুদ দাওয়াহ ইলাল কুরআনি ওয়াস সুন্নাহ-আফগানিস্তান, জমঈয়তে মুহাম্মাদিয়া ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া এবং জামায়াত আনসারুস সুন্নাহ- মিসর, সুদান ও ইরিত্রিয়া, জমঈয়তে এহইয়াউত তুরাস আল ইসলামী-কুয়েত এবং জমঈয়তুল বির-দুবাই ইত্যাদি পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থিত সালাফী দাওয়াতি সংগঠন।
অনুরূপভাবে জমঈয়তে আহলে হাদীস ওয়ার্ল্ড এসেম্বলী অফ মুসলিম ইয়ুথ (WAMY),রাবেতা আলম আল ইসলামী, ওয়ার্ল্ড ইসলামিক কাউন্সিল অব লন্ডন, ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক কাউন্সিল ফর দাওয়াহ এন্ড রিলিফ-কায়রো এর সদস্য।
(সমাপ্ত)
আরও পড়ুন:
ভারতবর্ষে আহলে হাদীসদের প্রকৃত ইতিহাস-১ম পর্ব
Amader k aaro tatpor hote hobe
For me it is very expected.