ভারতবর্ষে আহলে হাদীসদের প্রকৃত ইতিহাস-১ম পর্ব

ahle hadith1ভারতবর্ষে আহলে হাদীসদের প্রকৃত ইতিহাস

রচনায়: ওয়ার্ল্ড এসেম্বলি অফ মুসলিম ইয়োথ (WAMY)

অনুবাদক: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল

আহলে হাদীসের রিচয়:

ভারতবর্ষে প্রাচীনতম ইসলামী আন্দোলনের নাম হল আহলে হাদীস আন্দোলন। এই আন্দোলনের ভিত্তি হলসাহাবীতাবেঈ ও তাদের অনুসারী পূর্ববর্তী মনিষীদের বুঝ ও ব্যাখ্যার আলোকে কুরআন-সুন্নাহর অনুসরণ করা এবং এই দুটো জিনিসকে আকীদা, ইবাদত, মুয়ামালাতনীতি-নৈতিকতারাজনীতি তথা জীবনের সকল ক্ষেত্রে অন্য কোন মানুষের মতামতচিন্তা-চেতনা ও আদর্শের উপর অগ্রাধিকার দেয়া। সেই সাথে শিরকবিদআত ও সকল প্রকার অপসংস্কৃতি মূলোৎপাটনে কাজ করা।

ভারতবর্ষে আহলে হাদীসের প্রতিষ্ঠা ও উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব:  

ভারতবর্ষে আহলে হাদীস আন্দোলনের ইতিহাস ইসলামের সূচনা লগ্নের সাথে সম্পর্কিত। আরব বনিক ও মুজাহিদগণ ভরতের সমূদ্রতীরবর্তী কতিপয় অঞ্চল যেমনসিন্ধুমালাবার (বর্তমান কেরালা) ও গুজরাতে পৌঁছলে তাদের প্রচেষ্টায় সে সকল এলাকা ইসলামের আলোকে আলোকিত হয়ে উঠে। ফলে সিন্ধের বিভিন্ন অঞ্চলে এবং মুলতানে আহলে হাদীসদের বেশ কিছু মারকায (কেন্দ্র) গড়ে উঠে এবং সেখানে আরব-অনারব মুহাদ্দিসগণ আগমন করেন।

বিখ্যাত পরিব্রাজক আবুল কসেম আল মাকদেসী ৩৭৫ হিজরীতে অত্র এলাকা পরিভ্রমণে এসে তার আহসানুত তাকাসীম গ্রন্থে সিন্ধের বিভিন্ন এলাকার ধর্মীয় অবস্থা বর্ণনা গিয়ে লিখেন:

সেখানকার অধিকাংশ জন-সাধারণের মাযহাব হল,তারা আহলে হাদীস। তবে গুটি কয়েক ফকীহ হানাফী মাযহাব থেকে মুক্ত ছিলেন না। সেখানকার অধিবাসীগণ সঠিক পথ,প্রশংসনীয় মাযহাব, নির্ভেজাল ও পরিচ্ছন্ন নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে মযহাবী গোঁড়ামি, বাড়াবাড়ি ও ফিতনা-ফ্যাসাদ থেকে মুক্ত রেখেছিলেন।

হিজরী চতুর্থ শতকের শেষ দিকে এসে আহলে হাদীস আন্দোলনে দুর্বলতা শুরু হয় এবং হিজরী নবম শতকে এসে তা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে। এর কারণ ছিলরাজনৈতিক দলাদলিগোঁড়ামিবাতেনী ইসমাঈলী সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে আহলে সুন্নতের উপর বিভিন্ন ধরণের ফিতনা-ফ্যাসাদ, তাক্বলীদ ও মাযহাবী গোঁড়ামিইউনানি জ্ঞান-বিজ্ঞানের ব্যাপকতা ইত্যাদি নানা সমস্যা।

কিন্তু এতদসত্বেও তখনও ভারত উপমহাদেশে ইবনে হাজার আসকালানী (রহঃ)ইমাম সাখাবী এবং শাইখুল ইসলাম জাকারিয়া আনসারী প্রমুখের বেশ কতিপয় আহলে হাদীস ছাত্র ও বিশিষ্ট আলেম বিদ্যমান ছিলেন যারা আহলে হাদীস মানহাজকে সংরক্ষণ করে যাচ্ছিলেন।

আধুনিক যুগে আহলে হাদীসঃ

হিজরী এগারো শতকের সূচনা লগ্নে শুরু হয় আহলে হাদীসদের নতুনভাবে পথ চলা।

শাইখ আহমদ সিন্ধ (মৃত্যু: ১০৩৪ হি:) এর মাধ্যমে এই আন্দোলন পুনর্জীবিত হয়। আর শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবী (মৃত্যু: ১১৭৫ হি:) এর জমানায় তা শক্তিশালী হয়। বিশেষ করে তার বড় ছেলে শাহ আব্দুল আযীয দেহলবী (জন্ম: ১১৫৯-মৃত্যু: ১২৩৯ হি:) এর জমানায় তা আরও শক্তিশালী রূপ পরিগ্রহ করে। তিনি দাওয়াততাবলীগতাদরীসতালীফ ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাঁর পিতার রীতি অনুসরণ করেন। তিনি মাযহাবী গোঁড়ামি ও দীনি গবেষণায় স্থবিরতা বর্জন করেন।

পর্যায়ক্রমে তাঁর নাতী দাওয়াত ও জিহাদের সিপাহসালার এবং বিখ্যাত তাকবিয়াতুল ঈমান গ্রন্থের লেখক আল্লামা শাহ ইসমাইল বিন আব্দুল গনী দেহলবী (মৃত্যু: ১২৪৩ হি:) এর সময় আহলে হাদীস আন্দোলন আরও শাক্তিশালী ভাবে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে।

বালাকোটের যুদ্ধে (মৃত্যু: ১২৪৩ হি:) ইমাম শাহ ইসমাইল (রহঃ) নিহত হলে আহলে হাদীসগণ পূর্ণ আমানত ও ইখলাসের সাথে দাওয়াত ও জিহাদের দায়িত্ব নিজ স্কন্ধে তুলে নেয়।

এই পর্যায়ে তাদের কার্যক্রম মৌলিকভাবে তিনটি ময়দানে সর্বাধিক গুরুত্ব পায়। সেগুলো হল, জিহাদতালীফ-তাসনীফ (বই-পুস্তক রচনা) এবং তাদরীস (শিক্ষণ ও প্রশিক্ষণ)।

১. জিহাদের ময়দানে আহলে হাদীসঃ

শাহ ইসমাইল দেহলবী (রহঃ) এর আন্দোলন কুরআন-সুন্নাহর উপর আমল করার আহ্বানকে পুনর্জীবন দান,খিলাফাহ আলা মিনহাজিন নবুওয়াহ (নবুওয়তের ধারায় খিলাফত) প্রতিষ্ঠা, মাযহাবী গোঁড়ামি ও চিন্তা-ধারায় স্থবিরতা,বিদআত ও বাতিল আকীদাকে মূলোৎপাটন করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না বরং তার জিহাদি আন্দোলন শিখ ও সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে নেতৃত্ব প্রদান করেছে। বিশেষ করে ভারতের উত্তরাঞ্চলের সীমান্তবর্তী এলাকা সমূহে তার সংগ্রাম বিশাল ভূমিকা পালন করেছে। ইংরেজগণ ১৯৪৭ খৃষ্টাব্দে ভারত থেকে বিতাড়িত হওয়া পর্যন্ত তার এ আন্দোলন-সংগ্রাম অব্যাহত ছিল।

অতঃপর ভারত-পাকিস্তান বিভক্ত হওয়ার পরেও তার নেতৃত্বে মুজাহিদগণ জিহাদ অব্যাহত রাখে এবং তাদের একটি বাহিনী মুযাফফরাবাদ শহর জয় করে।

শাইখ ফজল এলাহি ওযীরাবাদী এর নেতৃত্বে উত্তরাঞ্চলের অন্যান্য কয়েকটি শহর অধিকৃত হয় যেগুলোর সমন্বয়ে বর্তমানে আজাদ কাশ্মীর গঠিত।

জিহাদের ময়দানে আরও উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব হল শাইখ বেলায়াত আলী সাদেকপুরী (মৃত্যু: ১২৬৯ হি:), তার ভাই এনায়েত আলী সাদেকপুরী (মৃত্যু: ১২৭৪ হি:) ও সাদেকপুরী পরিবারের অন্যান্য সদস্যগণ-যারা এই জিহাদের ঝাণ্ডাকে উড্ডীন রাখেন এবং এ ক্ষেত্রে তারা অনেক কষ্ট ও ত্যাগ তিতিক্ষা শিকার করেন।

২. তালীফ-তাসনীফ (বই-পুস্তক রচনা) এর ময়দানে আহলে হাদীসগণঃ

আহলে হাদীসগণ তা’লীফ-তাসনীফের মাধ্যমে ইসলামী সংস্কৃতির পুনর্জীবন দানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। উলূমুল কুরআনউলূমুল হাদীস, হাদীসের ভাষ্য গ্রন্থ রচনা, বিশুদ্ধ আকীদা ও তার বিরুদ্ধাচারণ কারীদের জবাববিদআত ও বাতিল আকীদা পন্থীদের প্রতিবাদ ইত্যাদি ক্ষেত্রে আহলে হাদীস আলেম ও মুহাদ্দিসগণ লিখনির মাধ্যমে পর্যাপ্ত ভূমিকা পালন করেন।

এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিগণের মধ্যে অন্যতম হলেন,ভূপালের শাসক নওয়াব সিদ্দীক খান ভূপালী (মৃত্যু: ১৩০৭ হি:)। তিনি গ্রন্থ রচনা,গবেষণা, প্রকাশনা এবং হাদীসের বড় বড় কিতাব লিখনীতে বিশাল অবদান রাখেন। বিভিন্ন বিষয়ে তিনি তিনশ’র অধিক গ্রন্থ রচনা করেন। জ্ঞান-গবেষণার পাশাপাশি তিনি রাষ্ট্র পরিচালনা করেন এবং সালাফী আলেমগণের সমন্বয়ে বই-পুস্তক রচনাঅনুবাদ ও শিক্ষকতার জন্য একটি বোর্ড গঠন করেন এবং নিজ খরচে সালফে-সালেহীনের লিখিত বই পুস্তক বিশেষ করে আকীদার মূলনীতি,তাফসীর ও হাদীসের গ্রন্থাদি প্রকাশ ও বিতরণের জন্য কয়েকটি ছাপাখানা তৈরি করেন।

৩. দারস-তাদরীসের ময়দানে আহলে হাদীসঃ

দারস-তাদরীসের ময়দানে আহলে হাদীসগণ পর্যাপ্ত গুরুত্ব দেন এবং দাওয়াহতাদরীসমাদরাসাজামেয়া ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করেন। এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব হল. আল্লামা শাইখ নাজির হুসাইন মুহাদ্দিসে দেহলভী (মৃত্যু: ১৩২০ হি:)।

তিনি ছিলেন ভারত উপমহাদেশে ইলমে হাদীস চর্চায় পথিকৃৎ। তিনি দিল্লিতে প্রায় ৬০ বছর যাবত ইলমে হাদীস ও অন্যান্য দীনি বিষয়ে দারস ও তাদরীসের খেদমত আঞ্জাম দেন। পাশাপাশি তিনি সঠিক আকীদা ও বিশুদ্ধ ইসলামের দাওয়াতেও অবদান রাখেন।

বলা হয়ে থাকেতার সময়কালে প্রায় দুই মিলিয়ন মুসলিম শিরক-বিদআত থেকে তওবা করে সহীহ আকীদা গ্রহণ করে। এই মহা মনিষীর মাধ্যমে আধুনিক যুগের অনেক বড় বড় মুহাদ্দিস ও দাঈ তৈরি হয়। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন:

১) প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা আব্দুল্লাহ গজনবী (মৃত্যু: ১২৯৮ হি:)

২) শামসুল হক আযীমাবাদী (মৃত্যু: ১৩২৯ হি:) (সুনান আবু দাউদের ভাষ্য গ্রন্থ আউনুল মাবুদের প্রণেতা)

৩) আল্লামা আব্দুর রহমান মুবারকপুরী (মৃত্যু: ১৩৫৭ হি:) (সুনানে তিরমিযীর ভাষ্য গ্রন্থ তুহফাতুল আহওয়াযী এর প্রণেতা)

৪) আল্লামা বাশীর সাহসাওয়ানী (মৃত্যু: ১৩২৬ হি:) (সিয়ানাতুল ইনসান আ’ন ওয়াসওয়াসাতিশ শাইখ দাহলান’ গ্রন্থের প্রণেতা)।

৫) শাইখ আব্দুল্লাহ বিন ইদরীস সানুসী মাগরিবী।

৬) শাইখ সাদ বিন হামাদ বিন আতীক নাজদী। যিনি তাঁর শাইখ আল্লামা নাযীর হুসাইন মুহাদ্দিসে দেহলভীর হাদীসের সনদ হেজায ও নজদ সহ আরবের বিভিন্ন এলাকায় সম্প্রসারিত করেছিলেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত মাদরাসায়ে নাযির হুসাইন দেহলভী অদ্যবধী দিল্লীতে বিদ্যমান রয়েছে। সেখান থেকে এখনও অনেক আলেম ও দায়ী ইলাল্লাহ বের হয়ে ইসলামের খেদমতে অবদান রাখছে।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

6 thoughts on “ভারতবর্ষে আহলে হাদীসদের প্রকৃত ইতিহাস-১ম পর্ব

  1. যাযাকুমুল্লাহু খায়রান ফিদ্দারায়েন, ওয়া আহসানুল যাজা।

  2. شكرالك كثيرا ياشيخ الفاضل الأخ الكريم عبدالله الهادي حفظكالله تعالى في الدنيا واللآخرة

  3. Pingback: ভারতবর্ষে আহলে হাদীসদের প্রকৃত ইতিহাস- ৪র্থ পর্ব (সমাপ্ত) | কুরআন-সুন্নাহ আমার জান্নাতের পথ

  4. Pingback: ভারতবর্ষে আহলে হাদীসদের প্রকৃত ইতিহাস-৩য় পর্ব | কুরআন-সুন্নাহ আমার জান্নাতের পথ

  5. Pingback: ভারতবর্ষে আহলে হাদীসদের প্রকৃত ইতিহাস-১ম পর্ব-২য় পর্ব | sogoodislam

  6. Pingback: ভারতবর্ষে আহলে হাদীসদের প্রকৃত ইতিহাস-২য় পর্ব | কুরআন-সুন্নাহ আমার জান্নাতের পথ

আপনার মতামত বা প্রশ্ন লিখুন।

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s